লেনদেন তলানিতে, ডুবছে পুঁজিবাজার ।৩৯২টি শেয়ারের তিন শতাধিকে ক্রেতা নেই
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ফ্লোর প্রাইস, যা বিশ্বে নজিরবিহীন, একটি ‘ঢাল’ বানিয়ে শেয়ারবাজারের পতন রোধ করতে চেয়েছিল। এখন পুঁজিবাজার সেই তলানিতে তলিয়ে যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের বিনিয়োগও তলিয়ে যাচ্ছে। এই ফাঁদে পুঁজিবাজারে তিন-চতুর্থাংশ শেয়ার কার্যকরভাবে অবিক্রেতা হয়ে উঠেছে, লেনদেন আড়াই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
সোমবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সারাদিন লেনদেন হয়েছে ১৫০ কোটি টাকার নিচে, যেখানে মাত্র ১৪৬ কোটি ৫১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, গত আড়াই বছরে ৬০৮ কার্যদিবসে মাত্র চার কার্যদিবসের লেনদেন ২০০ কোটি টাকার বেশি হয়নি। গতকালের লেনদেন ছিল এর মধ্যে একটি। এ ধরনের তিনটি লেনদেনের মধ্যে বাকি দুটি গত সপ্তাহে হয়েছে। ২০০ কোটি টাকার বেশি নয় চতুর্থ লেনদেনটি ৭ জুলাই, ২০২০-এ হয়েছিল, যার পরিমাণ ছিল ১৩৮ কোটি টাকা। এর চেয়ে গতকাল লেনদেন হয়েছে মাত্র আট কোটি টাকা বেশি।
তালিকাভুক্ত ৩৯২টি স্টক এবং মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে সোমবার ৩২৯টি লেনদেন হয়েছে, ডিএসই জানিয়েছে। তবে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শীর্ষ ১০টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৮৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, যা মোট শেয়ারের প্রায় ৫৮ শতাংশ। এ ছাড়া শীর্ষ ২০, ৫০ ও ১০০টি শেয়ারের লেনদেন হয়েছে যথাক্রমে সাড়ে ৭৬ শতাংশ, সাড়ে ৯৪ শতাংশ এবং ৯৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অন্য কথায়, লেনদেনের নীচের দিকে ২২৯টি শেয়ারের লেনদেনের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ কোটি টাকা বা মোটের মাত্র ১.১৭ শতাংশ। অর্থাৎ বেশিরভাগ শেয়ারের লেনদেন হয় না। এছাড়া ক্রেতা না থাকায় ৬৩টি কোম্পানির লেনদেন হয়নি।
ফ্লোর প্রাইস নামক তথাকথিত সুরক্ষাই এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, শেয়ারবাজারে শেয়ারের দাম বাড়বে বা কমবে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। মেঝে মূল্য এই ব্যবস্থা প্রতিরোধ. শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার ফাঁস হওয়ার ভয়ে তারা এসব ‘সরল সত্য’ বলতে রাজি হননি।
তবে সংকট আরও গভীর থেকে গভীরতর হতে চলেছে বলে ধরে নিয়ে ২২ ডিসেম্বর শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তালিকাভুক্ত ৩৯২টি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে মাত্র ১৬৭টির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানিটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, লেনদেন বাড়াতে কিছু শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, কম বাজার মূলধন রয়েছে এমন সব শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস সূচকে পড়বে না।
ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা জানান, পরিস্থিতি এমন যে, বিনিয়োগকারীদের চেয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে টাকার মায়া বেশি। ফ্লোরের দাম এমনভাবে বাড়ানো হয়েছে যাতে তাদের পতন সূচকের পতনকে ত্বরান্বিত করে না। ‘স্ট্যান্ডার্ড সার্কিট ব্রেকার’ বাদ দিয়ে বাজার মূলধনে ওই ১৬৭টি শেয়ার ও ফান্ডের শেয়ার ৫ শতাংশ হলেও লোয়ার সার্কিট ব্রেকার রাখা হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। অর্থাৎ নির্দিষ্ট দিনে ওইসব শেয়ারের দাম ১ শতাংশের বেশি কমতে পারে না।
এর ফলে অন্য সব শেয়ারের সঙ্গে ফ্লোর প্রাইস দেওয়া শেয়ারের লেনদেন আরও কমেছে। ফ্লোর প্রাইস উঠানোর আগের দিন ২২ ডিসেম্বর যেখানে ১৬৭টি শেয়ার ৫৮ কোটি টাকায় লেনদেন হয়েছিল, গতকাল তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৬৬ লাখ টাকায়। তাছাড়া মোট লেনদেন ২২৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা থেকে ১৫০ কোটি টাকার নিচে। এখনও ২২৪টি শেয়ার ফ্লোর মূল্য কার্যকর রয়েছে, যার মধ্যে ১৭৮টি বকেয়া রয়েছে।
ফ্লোর প্রাইস বর্তমান শেয়ারবাজারের প্রধান সংকট কিনা এমন প্রশ্নে ডিএসইর ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নানা আশঙ্কাও একটি কারণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফ্লোরের দামই বড় সমস্যা তৈরি করেছে।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, যে শেয়ার প্রতি শেয়ার বা ইপিএসে ৫ টাকা আয় দিয়ে ১০০ টাকায় কেনা-বেচা হয়েছে, এখন তার ইপিএস ৩ টাকা হওয়ার পর বা কমার আশঙ্কা থাকলে বিনিয়োগকারীরা কি সেই শেয়ার কিনবেন? হার? ফ্লোর প্রাইস এমন একটি সিস্টেম, যা ১০০ টাকার নিচে শেয়ার কেনার অনুমতি দেয় না। ফলে এসব শেয়ার কেউ কিনছে না। ফ্লোরের দাম পুরোপুরি না উঠলে বাজার সংকট অব্যাহত থাকবে।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, অর্থনীতি নিয়ে আতঙ্ক, ব্যাংক খাতে ডাকাতির কারণে মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বড় ও সেরা ব্যাংকটি এখন দেউলিয়া হয়ে গেছে। অনেক আমানতকারী টাকা তুলে নিচ্ছেন। উত্তোলনের চাপ সামলাতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শরিয়াহ ব্যাংকের মাধ্যমে সুদে টাকা ধার করেছে। এগুলো ভালো লক্ষণ নয়। আবার শেয়ারবাজারে যে কম ডাকাতি হয়েছে তাও নয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে নেবেন, এটাই স্বাভাবিক।