সমন্বয়ের অভাবে
সামান্য বৃষ্টিতেই দুর্যোগপূর্ণ নগরীতে পরিণত হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রাম। বন্যার কারণে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে তালা ঝুলতে হবে। ব্যাংক, বীমা থেকে নেমে আসছে দেশের প্রধান পাইকারি গন্তব্য চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে স্থবিরতা। নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। ড্রেনে পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। এমনকি পাহাড় ধসে পড়ছে।
এ ধরনের দুর্যোগের পেছনে অপরিকল্পিত নগরায়ন, পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি স্থাপন, সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও জনগণের অজ্ঞতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, “আগে পানি প্রবাহে কোনো বাধা ছিল না। অনেক বৃষ্টি হলেও পানি উপত্যকায় চলে যেত। এখন চট্টগ্রাম নগরীতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। পানি। প্রকল্প বাস্তবায়নে দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে।এছাড়া সিটি করপোরেশন, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, রয়েছে মানুষের অসচেতনতা। এসব কারণে বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে।
মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না
জলাবদ্ধতা মোকাবেলায় চট্টগ্রাম শহরের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় ১৯৬১ সালে। সেই মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী নগরীতে ৭০টি খাল ছিল। ৬২ বছর পর নগরীতে খালের সংখ্যা এখন ৫৭টি। অর্থাৎ ১৩টি খাল বিলীন হয়ে গেছে। ১৯৯৫ সালে আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছিল। এতে চারটি নতুন খাল খনন ও পুরনো খাল সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই পরিকল্পনা উপেক্ষা করে জলাবদ্ধতা নিরসনে ১১ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু লাভ তেমন একটা হয়নি। উল্টো নদীর দুই পাশের বন্যাকবলিত জমি বেদখল হয়ে গেছে, যা অবৈধ নির্মাণ। আবাসিক এলাকা দ্বারা জলাধার দখল; একের পর এক বহুতল ভবন উঠছে।
বন্যার ঝুঁকি নিয়ে গবেষণারত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিএইচবি) ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের প্রধান ড. মাহবুব মোর্শেদ বলেন, “বৃষ্টি হলেই পানি খাল, নালা-নদীতে হয়ে যায়। কিন্তু এই পানির প্রবাহ এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেবা সংস্থাগুলো নিজেদের মতো করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ফলে এ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার ক্ষতি প্রকট। সামনে এরকম আরও বিপর্যয় আসবে, ক্ষয়ক্ষতিও বাড়বে।
অরিকেলের প্রশস্ততা হ্রাস পায়
সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের সাবেক অধ্যাপক ইদ্রিস আলীর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১০ সালের আগে শাহ আমানত সেতু এলাকায় কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল ৯০০ মিটার; যা এখন ৫২০ মিটারে দাঁড়িয়েছে। নদীর প্রস্থ ৫০ থেকে কমে আড়াইশ মিটার হয়েছে। ফলে নদীর শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে। একই সঙ্গে নগরীর পানি নিষ্কাশনের জন্য ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ খালও হারিয়ে গেছে।
বিলীন হয়ে যাচ্ছে জলাধার
১৯৮১ সালে চবির ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ড. শহিদুল ইসলামের করা এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, তখন চট্টগ্রাম নগরীতে জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৯৪১টি। ১৯৯১ সালে তার করা আরেকটি জরিপে দেখা যায়, দশ বছরে প্রায় ১৩ হাজার জলাশয়। শহর হারিয়ে গেছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ২০০৬-০৭- সালে একটি জরিপ চালিয়ে বলেছিল যে নগরীতে মাত্র৪,৫২৩টি জলাশয় ছিল। বর্তমানে কতটুকু পানি আছে তার সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই।
গত জুলাই মাসে নগরীতে বন্যার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ১৮টি খালে পানি চলাচলে ২০টি বাধার চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পতেঙ্গায় নির্মাণাধীন কর্ণফুলী টানেলের মুখে ৬০ ফুটের একটি খাল তিন ফুটের খালে রূপান্তরিত হয়েছে। এছাড়া নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার মাং গ্রুপ ইতোমধ্যে ৪১ নম্বর খালটি ভরাট করে ফেলেছে।