গোলাগুলি ‘নতুন ফাঁদ’
সব শিশু হলুদ স্কুল ড্রেস পরে আছেন. স্কুলের সবুজ ঘাসের মাঠে কেউ গোল্লাছুট খেলছিল, কেউ কানামাছি খেলছিল। পাহাড়ি এলাকায় আশ্বিনের দুপুরের রোদ মাথায় থাকে। রবিবার, ঘড়িতে দুপুর ২টা ১০ মিনিট। হঠাৎ বিকট শব্দ। বেশ কয়েকবার এমন শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ। শিশুরা মাঠ থেকে দৌড়ে স্কুলে চলে গেল। দৃশ্যটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তবর্তী ভজবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।
স্কুলের কাছেই কাঁটাতারের সীমান্ত, যা বাংলাদেশ ও মায়ানমারকে আলাদা করেছে। স্কুলের ঠিক পেছনেই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পোস্ট। রাখাইন রাজ্যের সীমান্ত জুড়ে এক মাস ধরে গোলাগুলি চলছে। গতকালও কয়েক রাউন্ড গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। সীমান্তে মিয়ানমারের এমন আচরণকে দেশটির জান্তা সরকারের ‘নতুন ফাঁদ’ হিসেবে দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গোলাগুলি ছাড়াও তাদের উদ্বেগ মিয়ানমারের ষড়যন্ত্র নিয়ে। আর সত্যি বলতে, শূন্য রেখায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ঠেকাতে মিয়ানমার তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বদলে সমস্যা বাড়ছে।
ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সৈয়দ-উর রহমান বলেন, সীমান্তের ওপারে গুলি চালানোর কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। ২৮ আগস্ট স্কুল থেকে ৪০০ গজ দূরে হামিদ-সুলতানের বাড়ির উঠানে একটি মর্টার শেল পড়ে। প্রায় প্রতিদিনই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এ অবস্থার কারণে গড়ে এক মাস প্রতিদিন ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে। আবার সীমান্তের ওপার থেকে গুলির শব্দ শুনে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের বাড়িতে নিয়ে যেতে স্কুলে আসেন।
ভজবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ করিম বলেন, ‘থাপ্পড়ের শব্দে ভয়ে বুক কাঁপছে। এমনকি রাতে অনেক সময় বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।
সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে গেলে বাসিন্দাদের উৎকণ্ঠা বেরিয়ে আসে নিজেদের কথায়। প্রবীণদের মধ্যে আতঙ্কের ছাপ তুলনামূলক কম। যাইহোক, মায়ানমারের অসামাজিক ঘটনা তরুণী ও শিশুদের মানসিকতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সীমান্তবর্তী অনেক পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। জিরো লাইনের কিছু রোহিঙ্গা অন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের স্বজনদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
৭২ বছর বয়সী নুরুল ইসলামের বাড়ি ঘুমধুমের তুমব্রুর ফকিরাকোনা এলাকায়। তিনি বলন, ‘আমরা শান্তি চাই; বার্মিজরা যুদ্ধ চায়। তারা যুগ যুগ ধরে সমস্যা সৃষ্টি করে আসছে।’ দুই নম্বর গনপাড়া ওয়ার্ডের জাফর আলম বলেন, ‘গতকাল সকাল ৮টার পর বিকট শব্দ শোনা যায়। লোকজন যাতে আতঙ্কিত না হয় সেজন্য কয়েকদিন আগে এলাকায় মাইকিং করা হয়েছিল। তারপরও বাচ্চারা ভয় পাবে।’
ঘুমধুমের বাসিন্দা আমিনা খাতুন সরকারের পাওয়া বাড়ির উঠানে বসে কথা বলছিলেন প্রতিবেশী নারী রাশিদা বেগমের সঙ্গে। কয়েকদিনের দৃশ্যপট সম্পর্কে জানতে চাইলে আমিনা বলেন, ‘এত কোলাহল হলে কে না ভয় পাবে! শিশুরা ঘুমের মধ্যেই চমকে উঠে। অনেকেই মাঠে কাজ করতে যেতে ভয় পান।’
তুমব্রু বাজারের চিত্রটা একটু ভিন্ন। অনেকে দোকানে বসে গল্পে ব্যস্ত। গ্রামের বাজারের আশেপাশে জড়ো হওয়া লোকজনও একই গল্প বলে। ওই বাজারের মুদি ব্যবসায়ী রাসেল জানান, মিয়ানমারে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার পর থেকে তুমব্রুর নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সীমান্তের বেশির ভাগ মানুষই নিরীহ। তারা শান্তিতে থাকতে চায়। তবে কয়েকদিন ধরে অনেকের মনে শান্তি নেই। সবাই নিরাপত্তার কথা ভাবছে। শুনলাম, জিরো লাইনে আশ্রয় নেওয়া কিছু রোহিঙ্গা অন্য ক্যাম্পে তাদের পরিচিতদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ঘুমধুমে বাঙালি, পাহাড়িসহ প্রায় ২৪ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার রয়েছে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায়। সীমান্তের ঠিক পাশেই বাস করে আরও দুই হাজার মানুষ। গতকাল নাইক্ষ্যংছড়িতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে- পরিস্থিতি আরও সঙ্কটজনক হলে সীমান্তের ৩০০ মিটারের মধ্যে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া যাবে। তবে সরানোর পর তাদের কোথায় রাখা হবে, বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি।
চেয়ারম্যান আরও বলেন, মিয়ানমার নিজেদের মধ্যে নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছে। তারা বিশ্ব সম্প্রদায়কে বোঝাবে যে মিয়ানমার এখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবেলা করছে। এই মুহূর্তে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।