কেএসআরএমে শ্রমিক নিহতের ঘটনায়, দায়সারা তদন্তে ক্ষোভ ট্রেড ইউনিয়নের
সম্প্রতি কেএসআরএম শিপইয়ার্ডে লোহার চাপায় নিহত শ্রমিক সুজনের মৃত্যুর ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরাম। এছাড়া কেএসআরএম শিপইয়ার্ড কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
আজ ২ এপ্রিল শনিবার সকাল সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে শ্রমিক নিহত ও আহতের ঘটনায় জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এছাড়া শ্রমিকদের জীবনমান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে ১২টি দাবিও উপস্হাপন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা গত ২৪ ফেব্রুয়ারি কেএসআরএম শিপইয়ার্ডে শ্রমিক সুজন নিহতর ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাছাড়া তদন্ত কমিটির কোনো সদস্য শ্রমিক পক্ষের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। অন্যদিকে সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও এখন পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এছাড়া দুর্ঘটনার পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্তের স্বার্থে ইয়ার্ড বন্ধের নির্দেশও পালন করেননি মালিকপক্ষ।
বক্তারা দাবি করেন, নিহত শ্রমিক সুজনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও কবির স্টিল শিপ ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধামাচাপা দিতে নানা অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে, কলকারখানা ও সংস্থাপন অধিদপ্তর জানিয়েছে যে নিহত শ্রমিক বমি করার পর নিচে পড়ে যান এবং পরে মারা যান; এ ধরনের বক্তব্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে প্রমাণিত হয় যে, কোনো প্রকার পূর্ব তদন্ত ছাড়াই কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের বক্তব্য মালিকের অপতৎপাতাকে সমর্থন ছাড়া আর কিছুই নয়।
বক্তারা দাবি করেন, দুর্ঘটনার পর প্রতিবারই মালিকপক্ষ দুর্ঘটনার কারণ, নিহত ও আহত শ্রমিকের সংখ্যা এবং আহতদের অবস্থান নিয়ে লুকোচুরির খেলা খেলে।
জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প খাত বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ লঙ্ঘন করছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা আরও বলেন, উল্লিখিত শ্রম আইনে পরিচালিত হলেও এ আইনে উল্লেখিত কোনো সুবিধা শ্রমিকরা পাচ্ছেন না। কর্মচারীদের কর্মসংস্থান কার্ড, পরিচয়পত্র ইত্যাদি দেওয়া হয় না। কর্মীদের ন্যূনতম ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম (পিপিই) দেওয়া হয় না। ইয়ার্ড মালিকরা সরাসরি শ্রমিক নিয়োগ করে না কিন্তু লাইসেন্সবিহীন ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজটি চুক্তিবদ্ধ করে। ২০১৮সালে ঘোষিত মজুরি বোর্ডের পুরস্কার অনুসারে এই খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হলেও শ্রম আইনের ১৪৮ ধারা অনুযায়ী প্রতি মাসে ১৬,০০০ টাকা এবং প্রতিদিন ৬১৫ টাকা বাধ্যতামূলক হলেও তা মানছেন না। আজকে মুনাফালোভী মালিকদের এমন কর্মকান্ডের তীব্র নিন্দা জানাই।
বাবু তপন দত্ত (আহ্বায়ক-টিইউসি), আলহাজ্ব সফর আলী (সেক্রেটারি-জেএসএল), এএম নাজিম উদ্দিন (বিএমআর), শফি বাঙ্গালী (জেএসএল), রিজওয়ার রহমান খান (বিএফটিইউসি), মোঃ নুরুল আবছার (বিএমসিজিটিডব্লিউএফ), ফজলুল কবির। মিন্টু, মোঃ আলী (বিএমএফ জাহাজ ভাঙ্গা কর্মী), ইফতেকার করিম (টিইউসি) ও মোঃ শরিফুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা শ্রমিকদের জীবনমান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১২টি দাবি উত্থাপন করেন। এইগুলো-
* কেএসআরএম শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডসহ অতীতে সংঘটিত সকল দুর্ঘটনার যথাযথ ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন করে দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
* দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা এবং আহত ও প্রতিবন্ধীকে ১৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ।
* বিএসবিআর এ’র ব্যবস্থাপনায় এবং স্ব-নিযুক্ত ইয়ার্ড মালিকদের সমস্ত কর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম প্রদান।
* বিএসবিআরএর ব্যবস্থাপনায় শিল্পে শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় ডাটাবেস সংরক্ষণ।
* ইয়ার্ডে আধুনিক, নিরাপদ এবং মোবাইল সরঞ্জামের ব্যবহার নিশ্চিত করা।
* জাহাজ কাটার আগে বর্জ্যেমুক্তকরণ।
* দেশের প্রচলিত শ্রম আইন, বিধি এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশনসমুহ মেনে ইয়ার্ড পরিচালনা করা।
* দেশের সংবিধান, শ্রম আইন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘোষণা / কনভেনশন দ্বারা স্বীকৃত ইয়ার্ড শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা।
* ২০১৮ সালে ঘোষিত মজুরি বোর্ডের পুরস্কার অনুযায়ী, ন্যূনতম মজুরি প্রতি মাসে ১৬ হাজার টাকা এবং দৈনিক মজুরি হবে ৬১৫ টাকা।
* ইয়ার্ডকে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ।
* দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা।
*শিপ রিনাইক্লিং বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি থাকতে হবে।