তারপরও তেলের তেলেসমাতি।
একের পর এক জাহাজ ভোজ্যতেল নিয়ে বন্দরে নোঙর করছে। শুধুমাত্র মার্চ মাসেই তিনটি জাহাজে প্রায় ৭৫,০০০ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল দেশে প্রবেশ করেছে। প্রায় ৬৪,০০০ টন অপরিশোধিত পাম তেলও আমদানি করা হয়েছে। তেলের আরও দুটি জাহাজ খুব কাছাকাছি সময়ে প্রবেশ করবে। শুধু ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসেই চার লাখ টনের বেশি ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। ২০২১ সালে ২৭ লাখ ৭১ হাজার টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করা হয়েছিল। এরপরও সয়াবিন তেলের বাজার অস্থির। তেলেসমতির তেল কমছে না!
ভোজ্যতেল স্টোরেজ টার্মিনালে পর্যাপ্ত তেল নেই। সাধারণত, জরুরী হিসাবে ট্যাঙ্ক টার্মিনালে কমপক্ষে ১৫ দিনের তেল সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু শেষ জাহাজটি আসার আগে টার্মিনালে মাত্র ১৪,০০০ টন ভোজ্য তেল মজুত ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এত ভোজ্যতেল ছাড়া হচ্ছে কোথায়? ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা মাত্র ২০ লাখ টন।
এখন সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বসুন্ধরা ও বাংলাদেশ ভোজ্যতেল ভোজ্যতেল আমদানি করছে। পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, আমদানিকারকরা অবৈধভাবে মজুদ করে সংকট তৈরি করছেন। তারা নির্দিষ্ট ডিলারের কাছে সীমিত পরিমাণে সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে। এ কারণে মিল গেটে চাহিদা অনুযায়ী ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, তারা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত তেল পাচ্ছেন না। পাইকারি বিক্রেতারা তেল মজুদ করার অভিযোগ করছেন খুচরা বিক্রেতারা।
খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগির আহমেদ গত ১৭ মার্চ খাতুনগঞ্জে ভোজ্যতেল সংক্রান্ত এক সভায় বলেন, “খাতুনগঞ্জের পাইকারী বিক্রেতারা সরকারের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে তেল বিক্রি করছেন। খুচরা পর্যায়ে তা মানা হচ্ছে না। মিলগেট থেকে প্রয়োজনীয় ভোজ্যতেল পাচ্ছেন না পাইকাররা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, দাম বাড়লেই পাইকারি বাজারে অভিযান চালানো হয়। গত সপ্তাহে এক ব্যবসায়ীকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। এভাবে হুটহাট জরিমানা করলে তাকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছে শোধনাগারগুলো।
মিলগেটে চাহিদা মেলেনি তেল : চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ হচ্ছে না বলে প্রমাণ পেয়েছে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। কর্মকর্তারা বেশ কয়েকটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে সত্যতা পান। কয়েকজন পাইকারের গুদামেও তেল মজুত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঢাকায় সিটি গ্রুপের কারখানায় অভিযানের পর চট্টগ্রাম এস আলমের সয়াবিন অয়েল মিলের দ্বিতীয় ধাপ চালু করেছে ভোক্তা অধিদফতর। রোববার বিকেলে কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেক এলাকায় এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এস আলম ভোজ্যতেল মিলে সর্বশেষ অভিযান চালানো হয়। অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালক ফয়েজ উল্লাহ বলেন, সরবরাহ আদেশের বিপরীতে ১৫ দিনের মধ্যে তেল সরবরাহের নিয়ম রয়েছে। তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডেলিভারি দিতে পারছেন না। তারা এই সমস্যার দ্রুত সমাধান করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তারা আগের চেয়ে তেলের সরবরাহ কিছুটা বাড়িয়েছে। এর আগে ১৩ মার্চও কারখানায় অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদফতর। ওই দিন কারখানার পরিশোধন ও বোতলজাত কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এ ছাড়া বোতলের মোড়কে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দাম পাওয়া গেছে।
গত ১৮ মার্চ খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুল আলম ৫০ ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ব্যবসায়ীরা জানান, মিলগেট থেকে তারা পর্যাপ্ত তেল পাননি। আরএম এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার শাহেদ-উল-আলম বলেন, “সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে পাইকারি বাজারে সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে। এখন মিলগেট ও খুচরা বাজারের দিকে তাকাতে হবে। সরকার কতটা নিয়ম মানছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
জবাবে মাহবুবুল আলম বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কেউ তেল বিক্রি করবে না। মিলগেট থেকে কেউ বেশি দামে তেল আনবে না। কোনো আমদানিকারক চাহিদা অনুযায়ী তেল সরবরাহ না করলে বা দাম বাড়ালে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করুন। খাতুনগঞ্জের কুখ্যাতি যাতে কেউ না পারে।
চট্টগ্রাম বন্দরে আসা সর্বশেষ জাহাজে তেল এনেছে সিটি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, এই জাহাজের তেল আগের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। তারপরও আমরা তেল আমদানি স্বাভাবিক রেখেছি। সরবরাহ প্রক্রিয়াও স্বাভাবিক। তিনি বলেন, নরওয়েজিয়ান পতাকাবাহী এমভি স্টিভেঞ্জার পাইওনিয়ার জাহাজটি ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্রাজিলের প্যারানাগুয়া বন্দর থেকে রওনা হয়েছিল। জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে ৩৪ দিন সময় নেয়। তিনি বলেন, মিলগেটে ভোজ্যতেল সরবরাহে কোনো সংকট নেই।