ভূমিহীন মা-মেয়ের অনিশ্চিত ভুবন
আমার সব স্বপ্ন শেষ! আমি এখন আমার মেয়েকে নিয়ে কিভাবে থাকতে পারি? মেয়েটার কি হবে! বাবাকে নিয়ে মেয়ের কত স্বপ্ন। আর পূরণ হয়নি। বাবা ছাড়া আমার মেয়ে কিছুই বুঝত না। তারা আমাকে অনেক ধ্বংস করেছে!’
সোমবার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডি পপুলার হাসপাতালে এভাবেই কাঁদছিলেন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ভুবন চন্দ্র শীলের স্ত্রী রত্না রানী শীল।
স্বামীর অপ্রত্যাশিত আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি বিধ্বস্ত। তাদের একমাত্র মেয়ে রানী শীল শোকে কাতর।
রত্না রানী কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘সন্তানের বাবাকে এভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে না। আর কারো স্বামীর এমন ভাগ্য হওয়া উচিত নয়।
সন্ত্রাসীদের বিচার হবে না? রত্নার এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? এর আগে সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে ভুবন চন্দ্র শীল মারা যান। এর আগে ওই আইনজীবী হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) সাত দিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তিনি অজ্ঞান, কিন্তু জীবিত ছিল. স্ত্রী-কন্যার অন্তরে আশা ছিল যে তাদের পরিবারের প্রধান পুরুষটি জেগে উঠবে।
আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে রত্না রানীর চিকিৎসা হবে। বাবার হাত ধরে, ভূমিকা পছন্দের জায়গায় এবং তীর্থস্থানে চলে যাবে। কিন্তু ভুবন চন্দ্র স্ত্রী ও কন্যার সংসার ছেড়ে চলে যান অন্ধকারে। তার মাথায় গুলি লাগে।
১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বিজি প্রেসের সামনের সড়কে শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ ওরফে মামুনের প্রাইভেটকার লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় একদল সন্ত্রাসী। এ সময় মোটরসাইকেলে আরামবাগে যাওয়ার পথে ভুবনের মাথায় গুলি লাগে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত একজনকে আটক করা হয়েছে।
পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আহত ভুবনকে প্রথমে শমরিতা হাসপাতালে এবং পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। বেলা দেড়টার দিকে ভুবনকে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনরা। সেখানে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। মাথায় থাকা গুলি শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার করে বের করা যায়নি।
পুলিশ জানায়, গতকাল ভুবনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়েছে। রাতে মরদেহ ফেনীর পরশুরামের নিজ গ্রামে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।
সংসার হারিয়ে অসহায় পরিবার
গতকাল জনপ্রিয় হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, মেয়ে ভূমিকা রানী শীলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন রত্না রানী শীল। পাশে নীরব স্বজনরা ভুবনের লাশের জন্য অপেক্ষা করছেন।
রত্না রানী তার পরিবারের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘এখন আমাদের কে দেখবে? মেয়েটা বাবাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। বাবার হাত ধরে তীর্থে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা হয়নি। এখন আমার মেয়ে কিভাবে তার ইচ্ছা পূরণ করবে?’
বাবার কথা মনে করিয়ে দিয়ে সূচনা বলেন, ‘আমাকে ব্যবসায়ী বানানোর অনেক পরিকল্পনা ছিল বাবার। বাবার সঙ্গে শাড়ি ব্যবসা নিয়ে অনেক গল্প হতো। এখন আর হবে না। কিন্তু বাবার আত্মা সবসময় আমাদের সাথে থাকবে।
ভূমিকা বলল, “আমি ছাগলের মাংস খেতে পছন্দ করি। তাই বাবা যখনই মাটন খেতেন, আমাকে ডেকে বলতেন, ‘মা, তোমাকে ছাড়া আজ মাটন খেয়েছি।’ তখন বাবাকে বলতাম, ‘আমাকে ছাড়া মাটন খাইলে কেন?’ এ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে ভূমিকা।
জটিল রোগে আক্রান্ত রত্ন
রত্না রানী শীল ক্যান্সারে আক্রান্ত। গত মে মাসে চিকিৎসার জন্য স্বামীর সঙ্গে চেন্নাই গিয়েছিলেন তিনি। সে সময় এসএসসি পরীক্ষার কারণে ভূমিকা তাদের সঙ্গে যেতে পারেনি। চিকিৎসার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর আবার চেন্নাই যাওয়ার কথা ছিল রত্নার। এবার তিনজনই একসঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
রত্না ভাঙা গলায় জানান, চেন্নাইয়ে চিকিৎসার পর তারা ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থানে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। মেয়েটি বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে চাইল। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে প্রতিদিন মোবাইল ফোনে কথা বলতেন। এখন সব শেষ. প্রিওশা বলেন, এসএসসি পাস করার পর তার বাবা তাকে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেন। এটা নিয়ে বাবার সাথে কথা বলতেন।