উত্তাল সময়ের স্বপ্নদ্রষ্টা
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক সিরাজুল আলম খান ষাটের দশকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি শুধু স্বপ্ন দেখেননি; জানবাজি তার স্বপ্ন পূরণের সংগ্রামে যোগ দেন। এই সময়েই তিনি কয়েকজন কমরেড নিয়ে নিউক্লিয়াস বা স্বাধীন বাঙালি বিপ্লবী পরিষদ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফাকে এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রামে উন্নীত করার শপথ নিয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে তিনি ব্যক্তিগত জীবনের সব ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে কাজ করেছেন।
ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ৭ জুন হরতাল পালনে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা অনন্য। তিনি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে শ্রমিকদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। আওয়ামী লীগের তখন কোনো শ্রমিক সংগঠন ছিল না। দু-একজন ছাত্র কর্মী নিয়ে তিনি আদমজী, পোস্তগোলা, তেজগাঁও প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলে ছুটে যান এবং শ্রমিক নেতাদের রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেন। সেদিন তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ, শ্রমিকরা ৭ই জুনের ধর্মঘটে বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ করে; যা আন্দোলনের ধরন পরিবর্তন করে। শহীদ মনু মিয়ার রক্তে রচিত সংগ্রামের পথ।
ঊনষট্টি আসে ৭ জুন। সারাদেশে আওয়াজ ওঠে- জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব; আইয়ুব বাঁচতে চাইলে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করুন। এই সংগ্রামের সংগঠনে ছাত্র সমাজের ১১ দফা প্রণয়ন বা ৬ দফাকে ১১ দফায় একীভূত করার অন্যতম কুশীলব সিরাজুল আলম খান। নিউক্লিয়াস আক্রান্ত ছাত্রলীগের উগ্র আন্দোলন ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’; ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ এবং ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি ধ্বনিত করে জাতিকে নতুন স্বপ্ন দেখায়। যে স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু, সিরাজুল আলম খান ও অল্প সংখ্যক তরুণের স্বপ্ন, তা ঊনসত্তরের আন্দোলনের ঝড়ো জোয়ারে ধীরে ধীরে সমগ্র জাতির স্বপ্নে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে ছাত্র-জনতার এক সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং ৩ মার্চ পল্টনে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এই সংগ্রামের মূল স্থপতি ছিলেন আলম খান। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান চিরস্মরণীয়। তিনি ছিলেন মুজিব বাহিনীর অন্যতম কান্ডারী।
স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলন-সংগ্রামে অনন্য ভূমিকার জন্য সিরাজুল আলম খান কাস্ত্রোকে আদর করে ডাকতেন। তাদের মধ্যে হৃদয়ের বন্ধন ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দুজনের পথ ভিন্ন হয়ে যায়। তারপরও তাদের আবেগঘন সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডে শিশুর মতো কেঁদেছিলেন সিরাজুল আলম খান। তিনি শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।
একাত্তরের যুদ্ধের পর সিরাজুল আলম খান আরেকটি যুদ্ধে প্রবেশ করেন। তার নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গঠিত হয়। তিনি ছিলেন দলের আদর্শিক নেতা ও মধ্যপন্থী। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে জাসদের ব্যানারে জড়ো হওয়া হাজার হাজার তরুণ, জাসদ হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি; সেই দেহ আজ খণ্ডিত। এর পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ঘটনার প্রভাব, নেতৃত্বও দায়ী। সেই ভার হয়তো সিরাজুল আলম খানকেই বহন করতে হবে। অতএব, সমাজ পরিবর্তনের জন্য তিনি যে সাহসী সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন তা কখনই ম্লান হবে না। সেই রাজপথ কাঁপানো সংগ্রাম পথ দেখাবে এবং সাহস যোগাবে ভবিষ্যতের সমাজ পরিবর্তনের সৈনিকদের।
জাসদ ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে তাকে কাছ থেকে দেখেছি। আমরা একসঙ্গে জেলে কাটিয়েছি। সিরাজুল আলম খানকে আমি চিনি। ব্যক্তিগত স্বার্থ তাকে কখনো স্পর্শ করেনি। তার জীবন ছিল দেশ ও মানুষের জন্য নিবেদিত। তিনি সব সময় দেশের কথা ভেবেছেন, মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন। আকিতদার সিরাজুল আলম খানের কোনো বাড়ি বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। বাংলাদেশ ছিল তার ঠিকানা।
যে ব্যক্তি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল, সেই রাষ্ট্র দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী সিরাজুল আলম খানের খোঁজ করে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি, ভাবতেও কষ্ট হয়! আর দশজন সাধারণ নাগরিকের মতো তিনিও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সিরাজুল আলম খান এ রাষ্ট্রের কাছে কখনো কিছু চাননি, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তার প্রাপ্য মর্যাদাও নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের কি কোনো দায় ছিল না?