রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘ব্লক রেইড’
জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। অনেক সাধারণ রোহিঙ্গার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীতিনির্ধারকরা ক্যাম্পকে ঘিরে একগুচ্ছ নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। লম্বাসিয়ায় মুহিবুল্লাহকে যে ক্যাম্পে হত্যা করা হয়েছিল সেখানে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা চারগুণ হয়েছে। প্রশাসন অবিরাম ‘ব্লক রেইড’ এবং চিরুনি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য আরও দুটি এপিবিএন ব্যাটালিয়ন প্রস্তাব করা হয়েছে। একজন ভাসানচরের দায়িত্বে থাকবেন এবং অন্যজন কক্সবাজারে। বর্তমানে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য এপিবিএন -এর তিনটি ব্যাটালিয়ন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার পুলিশ সুপার নাইমুল হক বলেন, তারা এখন মুহিবুল্লাহর হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য জোর দিচ্ছে। ক্যাম্পে ব্লক অভিযান সহ দিনরাত অভিযান চলছে। ক্যাম্পের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকায় আমি মনে করি মুহিবুল্লাহর হত্যাকারীরা বাইরে পালাতে পারেনি।
নাইমুল হক আরও জানান, লম্বাসিয়া ক্যাম্পে ৭০-৭৫ জন পুলিশ সদস্য ডিউটি করতেন। এখন তা বাড়িয়ে তিনশ করা হয়েছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী করা হয়েছে।
অভিযোগ আছে দিনের বেলা ক্যাম্পের আশেপাশে পুলিশি নিরাপত্তা থাকলেও রাতে সেখানে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় থাকে। এ ব্যাপারে নাইমুল হকের মন্তব্য- এই অভিযোগ সঠিক নয়। সন্ধ্যা ৭ টার পর ক্যাম্পের বাইরে যেকোনো রোহিঙ্গার চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। করোনার অবস্থার উন্নতি হওয়ার সাথে সাথে আরও সক্রিয় আইন প্রয়োগকারী বাহিনী ক্যাম্পটি ঘিরে ফেলে। এখানে আরো অনেক কোম্পানি কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সশস্ত্র গোষ্ঠী ও উপদলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যাম্পে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা হয়েছে। ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের বিদ্যমান তিনটি ব্যাটালিয়নের মধ্যে একটি সমন্বিত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এত বড় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কার্যকরী পর্যবেক্ষণ পূর্ব গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া অসম্ভব।
চলমান ঘটনার পর, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশেপাশে পুলিশের চেকপোস্ট এবং পায়ে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও নজর রাখা হচ্ছে। ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, এখানে ওয়াচ টাওয়ার নির্মিত হলে নজরদারি করা সহজ হবে। কারণ, ক্যাম্পের অনেক এলাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনী কেটে ছোট ছোট পথ তৈরি করা হয়। কেউ কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপদে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ওয়াচ টাওয়ার তৈরি হয়ে গেলে, ২৪ ঘণ্টার নিরাপত্তা বেষ্টনী পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।
ক্যাম্পের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ এখানে একসঙ্গে বসবাস করছে। এই অবস্থায় আইন -শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সহ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কিভাবে পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে হয় সে বিষয়ে অনেকেরই কোন প্রশিক্ষণ এবং ধারণা নেই। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরের সঙ্গে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করা মাঠ পর্যায়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করত।
জানা গেছে, বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশে এপিবিএন -এর তিনটি ইউনিটের অধীনে ২ হাজার পুলিশ বাহিনী দায়িত্ব পালন করছে। এই বাহিনীর রসদ সহায়তা অপর্যাপ্ত। আবার তাদের মধ্যে অনেকেই অমানবিক পরিবেশে বসবাস করছে। বাহিনী বাড়ানোর পাশাপাশি মাঠের সদস্যরা তাদের কাজের পরিবেশের মান বৃদ্ধির কথাও বলছেন।
আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, মুহিবুল্লাহকে একজন জনপ্রিয় নেতা হওয়ায় ইতিমধ্যেই তাকে পুলিশ সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। যাইহোক, মুহিবুল্লাহ পুলিশকে বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছিলেন যে তিনি সার্বক্ষণিক পুলিশের সাথে থাকলে তার স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হবে। প্রয়োজনে তিনি পুলিশের সাহায্য নেবেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা নেতাদের নিরাপত্তা আবার কড়া করা হয়েছে।
তদন্ত কতদূর যাচ্ছে? মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হত্যার মিশনে সরাসরি জড়িত কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। হত্যাকারীদের সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। আবার কেউ আসল অপরাধীদের আড়াল করতে এলোমেলো বক্তব্য দিচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের পর ক্যাম্পের আশেপাশে যেসব গ্রুপ ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল তাদের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। তাদের ধরার জন্য ধারাবাহিক অভিযান চলছে। এছাড়া মুহিবুল্লাহর পরিবারকেও বাড়তি নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশ।