সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি।রহস্য লুকিয়ে ৯ প্রশ্নের আড়ালে
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডিতে অন্তত ৪৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আগুন ও বিস্ফোরণে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে দুই শতাধিক মানুষ। ঘটনার আট দিন পরও আগুন থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের কারণ এখনও পাওয়া যায়নি। এটা নিছক দুর্ঘটনা নাকি অবহেলাজনিত হত্যা, তার সুরাহা হয়নি। যদি গাফিলতির কারণে এই ঘটনা হয়ে থাকে, তবে দোষী কে তা জানা যায়নি। গুরুত্বপূর্ণ ৯ প্রশ্নের উত্তর দিলেই জানা যাবে এই অগ্নি-বিস্ফোরণের প্রকৃত সত্য।
এ ঘটনায় গঠিত ছয় তদন্ত কমিটির সদস্যরাও ৯টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দায়ীদের চিহ্নিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ, কোন রাসায়নিকের পরিমাণ, কেন রাসায়নিকের তথ্য গোপন রাখা হলো, শুধু দুর্ঘটনা বা নাশকতা, কেন আগুন নিয়ন্ত্রণে এত দেরি হলো, এ ঘটনার জন্য কারা দায়ী, মনিটরিংয়ের ভূমিকা? সংস্থা এবং ক্ষতির পরিমাণ। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে কী করা যেতে পারে সে বিষয়ে সুপারিশ করবেন তারা। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটির সদস্যরা কাজ শুরু করেছেন। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও আলামত সংগ্রহ করছেন। এসব উপসর্গ পরীক্ষার জন্য বিশেষায়িত পরীক্ষাগারে পাঠানো হচ্ছে।
বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশন, জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি বিএম ডিপো নিজেই তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রতিটি তদন্ত কমিটিতে পুলিশ, সেনাবাহিনী, কারখানা ও স্থাপনা পরিদর্শন এবং বিস্ফোরক দপ্তরের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত থাকে।
রহস্যময় অবিস্ফোরিত রাসায়নিক জার: বিএম ডিপোতে ৮৬ ঘন্টা ধরে আগুন জ্বলেছে। তারপরও রাসায়নিকযুক্ত কিছু প্লাস্টিকের জার অবিস্ফোরিত ছিল। কিছু জার ভর্তি রাসায়নিক পাত্রও অক্ষত রয়েছে। কারণ অনুসন্ধান করছে তদন্ত কমিটি। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কিছু কেমিক্যাল ভর্তি জার আগুনে গলে গেলেও কিছু অক্ষত রয়েছে। ডিপো কর্তৃপক্ষের দাবি, রাসায়নিকের উপস্থিতি সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসকে জানানো হয়েছে। একটি ভিডিওতে, একজন ডিপো আধিকারিককে বলতে শোনা গেছে যারা আগুন নেভাতে এসেছিল সেখানে রাসায়নিক রয়েছে। এমনটা বলার প্রয়োজন ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখছে তদন্ত কমিটি। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তথ্য গোপন রাখার অভিযোগ নিয়েও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কোন দিক থেকে ভুল হয়েছে তা জানতে চায় তদন্ত কমিটি।
নমুনা বিশেষ পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে: পেট্রোলিয়াম আইন অনুযায়ী, হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থের মধ্যে দাহ্য পদার্থ এবং দাহ্য পদার্থের তালিকায় নেই। অন্য কোনো দাহ্য পদার্থ আছে বলে তাদের সন্দেহ। এ জন্য ডিপো এলাকা পরিদর্শন করে নমুনা সংগ্রহ করেছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। নমুনাগুলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বিশেষায়িত পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে। এ ছাড়া সিআইডি, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও পরিবেশ বিভাগের সদস্যরা নমুনা সংগ্রহ করেছেন। ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে ডিপোর কাছের স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দিও নেওয়া হচ্ছে।
তদন্ত কমিটি রাসায়নিকের তালিকা চেয়েছে: অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে হাইড্রোজেন পারক্সাইড নিয়ে আলোচনা হলেও কমিটির সদস্যরা একমত নন। তদন্ত কমিটির প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগুনের ধরন বিশ্লেষণ করে আমরা মনে করি অন্য কোনো দাহ্য পদার্থ ছিল। এ কারণে একদিকে আগুন ভয়াবহ রূপ নিলেও অন্যদিকে মাত্রা কম। কিছু কন্টেইনার বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলেও কিছু কন্টেইনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এমন দ্বিমুখী ছবি আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। তাই আমরা ঘটনাস্থলে কতগুলি রাসায়নিক ছিল এবং কত ধরণের রাসায়নিক ছিল তার একটি তালিকা চেয়েছিলাম। এই তালিকা নিয়ে কাজ করলে কোন রাসায়নিক কতদিন ধরে আছে তার তথ্য বেরিয়ে আসবে।
অগ্নিকাণ্ডের পূর্ব প্রস্তুতিও জানতে চেয়েছে কমিটি: প্রায় সব তদন্ত কমিটিই খতিয়ে দেখছে বিএম ডিপোর অগ্নি নিরাপত্তা ও নির্বাপণ ব্যবস্থা সঠিক ছিল কি না। ডিপোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম, জলাশয় এবং ফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল কিনা তা ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখবে। অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা কেন ডিপোতে রাসায়নিকের রিপোর্ট দেয়নি তা খতিয়ে দেখছে কমিটি। গত বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে গিয়ে ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবানবন্দি নেয়। তারা আগুনের উত্স, রাসায়নিক কন্টেইনার এবং পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যবাহী পাত্রের বিস্তারিত তালিকা এবং রপ্তানিকারকদের বিবরণ সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিভিন্ন নথি তলব করেছে কমিটি।