কম্পিউটারে দুর্নীতির প্রমাণ মুছে আত্মগোপনে মনির

0
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকার একটা অংশ তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের মতো বিদেশেও পাচার করেছেন। পুলিশ, কারা অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন অধিদপ্তরে নিয়োগ, বদলির মাধ্যমে মনির হোসেন প্রায় শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএসের দপ্তরে থাকা মনির হোসেনের কম্পিউটারে নিয়োগ-বদলির অনেক প্রমাণ ছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদল হলে ওই দিনই মনির হোসেন কম্পিউটারে থাকা সব দুর্নীতির প্রমাণ ডিলিট করে আত্মগোপনে চলে যান। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে মনির হোসেনের বিরুদ্ধে একটি মামলা রুজু করেছে। জব্দ করেছে তার ব্যবহৃত কমিম্পউটার। কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক পাঠিয়েছে ফরেনসিক টেস্টে। দুদক মনির হোসেনের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছে, তাতে ১২টি ব্যাংক হিসাবে ৩১ কোটি ৩১ লাখ টাকা লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে। অন্যের ব্যাংক হিসেবেও টাকা রাখতেন মনির হোসেন, যাতে দুদকসহ প্রশাসনের অন্য কোনো সংস্থা তাকে ধরতে না পারে। জানা গেছে, ভোলার চরফ্যাশনের নিজ এলাকার জনৈক আল আমিনের ব্যাংক হিসেবেও দুর্নীতির টাকা রাখতেন মনির হোসেন। এই আল আমিন পেশায় ছাত্র। মনির হোসেন দুর্নীতির টাকায় চরফ্যাশনে দুটি হাসপাতাল বানিয়েছেন। এ ছাড়া সাগরে মাছ ধরার ৯টি ফিশিং বোটের মালিক মনির হোসেন। চরফ্যাশনের শশীভূষণ থানার আওতাধীন হাজারীগঞ্জ মাছের গদি মনির হোসেনের পক্ষে আব্বাস নামের এক ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করত। তার গদিতে মাছ না দিলে জেলেদের ওপর নানা খড়গ নেমে আসত। চরফ্যাশনের হাসপাতাল রোডে একটি আলিশান ৭ তলা ভবনের মালিক তিনি। মনির হোসেন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকার একটি অংশ বিদেশেও পাচার করেছেন বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে বাড়ি কিনেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস হওয়ার পর থেকেই মনির হোসেন ছিলেন তার এলাকার অধিপতি। তার কথায় চলত স্থানীয় প্রশাসন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের টিম সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁনসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে। এই তালিকায় মনির হোসেনও রয়েছেন। মনির হোসেন পুলিশে কনস্টেবল ও এসআই নিয়োগ দিতে তার কম্পিউটারে তালিকা বানাতেন। সেই তালিকার পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠাতেন। আর কনস্টেবল নিয়োগের তালিকায় সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের কাছে পাঠাতেন। এভাবে কারা অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পাসপোর্ট অধিদপ্তরসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্যান্য দপ্তরের নিয়োগেও হস্তক্ষেপ করতেন এমপিএস মনির। টাকার বিনিময়ে পুলিশের এসপি থেকে শুরু করে অতিরিক্ত আইজি পর্যন্ত নিয়োগ ও বদলি করতেন মনির হোসেন। এ কাজে যে টাকা আসত তার এক ভাগ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, এক ভাগ কামালের পিএস হারুর অর রশীদ বিশ্বাস এবং এক ভাগ যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস ভাগ করে নিতেন। এদের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেওয়া হতো সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা, কাউকে গ্রেপ্তার থেকে রক্ষা, বাড়ি দখল, জমি দখল বা অন্য যে কোনো স্থাপনার দখল দিয়ে কোটি কোটি নিতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস মনির হোসেন। পাশাপাশি চার্জশিট থেকে আসামি বাদ দিয়েও টাকা নিতেন। এমনকি অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েও মোটা অংকের টাকা নিতেন মনির হোসেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে এসব ব্যাপারে অনেক পিলে চমকানো তথ্য বেরিয়ে আসছে। মনির হোসেনের আয়কর নথি বিশ্লেষণ করে দুদক ঢাকার ঝিগাতলার ৭/এ রোডের ৬৪ নম্বর প্লটে .৫৬৪ কাঠা জমি, ২ হাজার ৬৭০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ও দুটি গ্যারেজ পেয়েছে। ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের মধ্যেরচরে পাঁচ কাঠা জমি, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মাইজগাঁওয়ে পাঁচ কাঠার একটি প্লট, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের দেওথান এলাকায় ২০ শতাংশ জমি, মোহনগঞ্জে টেংগাপাড়ায় ৫ একর জমি, ভোলার চরফ্যাশনে ৫.৫ শতাংশ জমি, চরফ্যাশনের চর নাজিমুদ্দিনে ৯৮.৮৮ শতাংশ জমি, চর নাজিমুদ্দিনে আরও ১৪৮ শতাংশ জমির মালিক হওয়ার তথ্য পেয়েছে দুদক। আয়কর নথিতে মনির হোসেন মোট ৯ কোটি ৭৫ লাখ ৪২ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে বিয়ের সময় উপহার হিসেবে পাওয়া ৬০ ভরি স্বর্ণালংকারের হিসাব দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক ও হাতে নগদ ২ কোটি ৪৫ লাখ ৫ হাজার টাকা, শেয়ারহোল্ডিংস ইন লিমিটেড কোম্পানিতে তার ৬ কোটি ৪৮ লাখ ৬২ হাজার টাকার শেয়ার থাকার কথাও উল্লেখ রয়েছে। তিনি এ কোম্পানির পরিচালক। তবে বেনামে রাখা অন্যান্য অবৈধ সম্পদের হিসাব মনির হোসেন তার আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি বলে জানা গেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের দপ্তর ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ আয় করতে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাস, যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে হারুন অর রশীদ বিশ্বাস বিদেশে পালিয়ে গেছেন। মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন গ্রেপ্তার হয়েছেন। ধনঞ্জয় কুমার দাস ও শরীফ মাহমুদ অপু এখনও গ্রেপ্তার হননি। আত্মগোপনে আছেন মনির হোসেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *