শহীদ বুদ্ধজীবী দিবস।এমন বুদ্ধিজীবী পাওয়া কঠিন

0

যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য- এটা উপলব্ধি করার পর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা আমাদের জাতির মেধাবী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। তাদের টুকরো টুকরো করে লাশ ফেলে দেওয়া হয় বুড়িগঙ্গার তীরে একটি পরিত্যক্ত ইটভাটায়। সমগ্র মুক্তিযুদ্ধে সারাদেশে অগণিত মানুষ ও বুদ্ধিজীবী নিহত হলেও ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় যে সুপরিকল্পিত গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। ২০১৩ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার রায়ে বলা হয়, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন ধরনের নৃশংস হামলা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস এমন অভিজ্ঞতার

মোকাবিলা করেননি, যেখানে জাতির বিবেক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করে গণহত্যা চালানো হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞ শুধু অপরাধীদের অপরাধের হারই বাড়ায়নি, গোটা জাতির জন্য দুর্ভোগের ছাপ রেখে গেছে। ৫০ বছরের দূরত্বে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সেই দুর্ভোগের ছাপ থেকে জাতি মুক্তি পায়নি। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হত্যার পর যে বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা কি পূরণ হয়েছে? ভাষাবিদ ও গবেষক আহমেদ রফিক বলেন, কোনো শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। ভাষা আন্দোলনের এই অগ্রদূত মনে করেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীরা জাতির এক টার্নিং পয়েন্টে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। প্রতিভা ও মেধার ক্ষেত্রেও তারা অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু কিভাবে তুলনা করব? ‘

অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহাও একই প্রশ্ন করেন, ‘এ সময়ের সঙ্গে কীভাবে তুলনা করব?’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক ও বর্তমানে বঙ্গবন্ধু চেয়ারের অধ্যাপক মনে করেন, ‘মেধাশূন্যতা মাপার কোনো পরিসংখ্যান তৈরি করা যায় না। সময় বদলে যায়। মানুষের চিন্তা বদলায়। আমরা যদি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ৫০ বছরের স্বাধীনতা-পূর্ব পাকিস্তানি আমলের ২৫ বছরের সঙ্গে তুলনা করতে চাই, তাহলে বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে এবং সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অবশ্য অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদের দিকে চোখ ফেরানোর জন্য সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ যে প্রত্যয় নিয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই প্রত্যয় থেকে দূরে সরে গেছে। লেখক-বুদ্ধিজীবীরাও এই পশ্চাৎপদতার জন্য দায়ী। অনেকে বলেনি এবং এখনও বলে না যে আমরা বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছি না। স্বপ্ন।যারা বলে, তারা মৃদুভাষী।স্বপ্ন ছিল একটি সঠিক গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল সম্পদের ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করা। সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব ছিল এই অগ্রযাত্রার সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিতে সাহায্য করা, তারা তা করেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার পর সমাজে তেমন কোনো জাগরণ আসেনি। মধ্যবিত্তের প্রচেষ্টায় বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ঘটে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনামলে অনেকেই রাষ্ট্রকে শত্রু মনে করতেন। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ আর বিদেশীদের হাতে নেই। যাদের সুযোগ আছে, তারা নিজেদের সুবিধা বাড়াতে ব্যস্ত।

বুদ্ধদেব বসুর কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যাপক যতীন সরকার বলেন, “দেশের বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা অনেকটা এমন হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীরা মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন। এখন এটা করা কঠিন। আমরা তুলনা ছাড়াই বলতে পারি, আমরা তাদের শূন্যতা পূরণ করতে পারিনি।

তিনি বলেন: ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্রগতির জন্য সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরিতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল। বুদ্ধিজীবীরা উর্দু-ফারসি-আরবি শব্দের সমন্বয়ে এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে ইসলামিকরণের প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা হয়। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের কবি হিসেবে চিহ্নিত। কবিতা থেকে হিন্দু শব্দ অপসারণের উদ্যোগ নেওয়ায় নজরুলকে তিরস্কার করা হয়। বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে খণ্ডিতভাবে নিষিদ্ধ করার সমস্ত পাকিস্তানি প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেন। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে পালিত হয় রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষ।

‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সংবাদ’, আত্মমূল্যায়ন-‘সহ বহু গ্রন্থের লেখক ও গবেষক যতীন সরকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উত্তরাধিকারী হিসেবে আমরা তাদের খ্যাতি ও কৃতিত্ব ধরে রাখতে পারিনি। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সীমানা রূপান্তরিত হয়েছে সংকীর্ণতায়। আজকের বাংলাদেশ পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। সংবিধানের চার মূলনীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। পাকিস্তানের ভূত বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *