কাটছে না ধোঁয়াশা থামছে না বিতর্ক। খালেদা জিয়ার রাজনীতি
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন কি না- সে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি। আইনের নানা ব্যাখ্যা ও তর্ক চলছে। চার সিনিয়র মন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে ভরপুর রাজনৈতিক মঞ্চ। সপ্তাহব্যাপী এই বিতর্ক থামবে বলে মনে হয় না। দুদিন আগে খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না বলে জানালেও এখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভিন্ন সুর। গতকাল সোমবার তিনি বলেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন কি না তা আদালতের সিদ্ধান্ত। আগের বক্তৃতায় তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না বলে জোরালোভাবে বললেও বিষয়টি আদালতে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনবিদরা। তারা বলছেন, এ বিষয়ে মন্ত্রীদের আকস্মিক বিভিন্ন বক্তব্যের পেছনে অন্য ‘রাজনীতি’ থাকতে পারে, যা তারা সরাসরি বলতে পারছেন না।
তবে দুর্নীতির মামলায় সাজা পাওয়ার পাঁচ বছর পর খালেদা জিয়ার হঠাৎ রাজনীতিতে আসা নিয়ে মন্ত্রীদের বক্তব্য আমলে নিচ্ছে না বিএনপি। বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখছে দলটি। বিএনপি নেতারা বলছেন, এর পেছনে কোনো ঝামেলা থাকতে পারে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে তারা হঠাৎ অহংকারী হয়ে উঠলেন কেন? একইসঙ্গে তার মুক্তি দাবি করে বলেন, খালেদা জিয়া পুরোপুরি মুক্তি পেলেই তার রাজনীতিতে ফেরা নিয়ে আলোচনা হবে। আগে মুক্তি, তারপর অন্য কিছু। বিষয়টি প্রথমে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সামনে আনেন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে রাজনীতি করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে না, কিন্তু তিনি ভোট দিতে পারবেন না। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকও একই কথা বলেন। এর দুদিন পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না। তার সঙ্গে একমত পোষণ করে বক্তব্য রাখেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাসান মাহমুদও। মন্ত্রীদের এমন বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেবেন কিনা তা সম্পূর্ণ তার সিদ্ধান্ত।
তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়ার স্থগিত সাজা প্রাসঙ্গিক নথিপত্র ও আইনি দিক বিশ্লেষণ করে পরবর্তী পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী সিনিয়র আইনজীবী ড. খুরশীদ আলম খান বলেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে আইনত বাধা রয়েছে। কারণ সে একজন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী। তিনি রাজনীতি করতে চাইলে আদালত থেকে ওই মামলায় তাকে খালাস বা জামিন দিতে হবে। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি রাজনীতি করতে পারে না। তিনি বলেন, অসুস্থতার কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত এবং শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছে। যেখানে খালেদা জিয়া আছেন, সেটি সাব-জেল। জেল কোড অনুযায়ী তাকে চলতে হয়। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এখানে সঠিক কথাই বলেছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার আইনি প্যানেলের অন্যতম সদস্য ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন কি না সেটা তার সিদ্ধান্ত। তিনি একজন অসুস্থ ব্যক্তি, সরকারের অনেক মন্ত্রী তাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত কথা বলছেন, মিথ্যাচার করছেন। এখানে সরকার ও আদালত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, প্যারোলে মুক্তি পেয়ে শেখ হাসিনা রাজনীতি করেছেন এবং সংসদ নির্বাচনও করেছেন।
তিনি পারলে খালেদা জিয়া কেন রাজনীতি করতে পারবেন না। এখন মনে হচ্ছে সরকার চাইলে খালেদা জিয়াকে নির্বাচন করতে পারে, না চাইলে পারবে না। রাজনীতি না করার মুচলেকায় খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করা হয়েছে বলে দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম গত ২৬ জানুয়ারি সংসদে বলেন, খালেদা জিয়া সাজা স্থগিতের রাজনীতি করবেন না বলে গ্যারান্টি দিয়েছেন। তার বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত হয়। এই বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক বিতর্ক রয়েছে। যদিও বিএনপি নেতারা তাদের দাবি নাকচ করে আসছেন। দুই দলের নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যে হঠাৎ করে সিনিয়র মন্ত্রীদের বক্তব্য রাজনীতিতে নতুন মাত্রা পেয়েছে। সরকারের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে বলেও জল্পনা শুরু হয়েছে। দেশি-বিদেশিদের কাছে নিজেদের গণতান্ত্রিক অবস্থান প্রমাণ করতে এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপিসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। ২৫ মার্চ ২০২০ সালে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে তিনি গুলশানে একটি ভাড়া বাসায় অবস্থান করছেন। সে সময় সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে ছয় মাসের জন্য শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা-৪০১(১) অনুসারে তার সাজা স্থগিত করা হয়েছে।