জামিনের আশায় গ্রাম থেকে পালিয়ে শহরে।হাইকোর্টে ভিড়
শরতের বিকেলে সবাই অফিসের পর বাড়ি ফেরে। যানজটে গাড়ির চাকা ঘুরছে না। হাইকোর্টের পাশের রাস্তার ফুটপাতে চায়ের স্টলে রাজ্যের হতাশায় সিগারেট ফুঁকছেন বেশ কয়েকজন। তারা সবাই গ্রেফতারের আশঙ্কা করছেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের চোখ এড়িয়ে রাজধানীতে পালিয়েছে তারা। জামিনের জন্য তারা হাইকোর্টে যাচ্ছেন। জামিন মেলে না। কথাবার্তায় উঠে আসে পালিয়ে আসা মানুষের কষ্টের কথা।
তাদের একজন ৪৮ বছর বয়সী আব্দুল মালেক। গত সোমবার নেত্রকোনার দুর্গাপুর থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। তার আসা-যাওয়া দুই দিন ধরে হাইকোর্টে। ২৫ নভেম্বর রাতে মালেক গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। হঠাৎ বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিয়ে পুলিশ জানায়, তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এমন তথ্য পেয়ে পুলিশকে বোকা বানিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায় সে। এরপর আর বাড়ি ফেরেননি তিনি। পরে স্থানীয় এক আইনজীবীর মাধ্যমে আগাম জামিন নিতে হাইকোর্টে আসেন তিনি। তবে জামিন মেলেনি। তিনি নাশকতার মামলার আসামি। মালেক বলেন, মামলার বিবরণে জানা যায়, ২২ নভেম্বর ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। তবে ওই দিন তিনি কিশোরগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন। জীবনে কখনো রাজনীতি করেননি। বাড়িতে স্ত্রী ও তিন মেয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শ্বশুরবাড়ির কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়েছি। সেই টাকাও শেষের পথে। এলাকার একটি ইটের ভাটায় ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত মালেক এখন বিষণ্ণতার অন্ধকারে নিমজ্জিত।
চাঁদপুর মতলব উত্তর থেকে আগাম জামিন নিতে আসেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি কৃষি কাজের পাশাপাশি মাটি কাটার ঠিকাদার। সম্প্রতি তার নামে মতলব উত্তর থানায় ককটেল অপকর্মের অভিযোগে মামলা হয়েছে। ঘরের গরু বিক্রি করে সাড়ে আট হাজার টাকা নিয়ে গত মঙ্গলবার ঢাকায় আসেন তিনি। বুধবার আইনজীবীর সঙ্গে কথাও বলেছেন তিনি। দেলোয়ার বলেন, তিনি বিএনপি সমর্থক হলেও কখনো সমাবেশ-মিটিংয়ে যাননি। এখন সে পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
নাশকতা, পুলিশের ওপর হামলা ও গোপন বৈঠকের অভিযোগে অভিযুক্ত পাঁচজনের একটি দল হাইকোর্ট চত্বরে দেখা করেছে। তারা নোয়াখালীর সুবর্ণচর থেকে এসেছেন। সেই দলের একজন। আব্দুলগাহ জানান, তিনি মাছ ধরার কাজ করেন। ১০ দিন ধরে পুলিশ বাড়িতে এসে তার খোঁজ করে। মামলাটি কী, তাও তিনি জানতেন না। পরে গ্রামের এক আইনজীবীর মাধ্যমে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ জানতে পারেন
তিনি অভিযুক্ত। গ্রুপের অন্য সদস্যের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি তার নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তার মতে, পত্রিকায় নাম প্রকাশ হলে আরও মামলা হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমি একটু কৃষিকাজ করে চা দোআঁ করে সংসার চালাই। ৭-৮ বছর আগে বিএনপি কাইত্তম। আমি রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি। হাছ ওক্ত নামাজ হরি। তবুও, আমি হায়ালগাম কিনিনি। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।’
এমন দীর্ঘশ্বাস আর হয়রানির অসংখ্য গল্প এখন ঢাকার আদালতে। কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকায় কাউকেই মামলায় আসামি করা হয়নি। আবার কেউ রাজনীতির কারণে একাধিক মামলার আসামি হয়ে আগাম জামিনের আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ জামিন পেলেও ভিড় কমে না। গত এক সপ্তাহে আদালত প্রাঙ্গণে বিএনপি নেতাকর্মী ও নিরীহ মানুষের আনাগোনা অনেক বেড়ে গেছে। জামিন আবেদনের শুনানির জন্য দীর্ঘ লাইন থাকায় নানা ভোগান্তির মধ্যে সময় কাটাতে হচ্ছে মামলার আসামিদের। কেউ কেউ ক্লান্ত শরীর নিয়ে কোর্টের বারান্দায় বসে আছে। আবার কেউ কেউ গাছের নিচে খোলা আকাশের নিচে বসে আছে।
বিএনপি জানায়, ২২ আগস্ট থেকে গত তিন মাসে দেশের ৫৮ জেলায় তিন শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামির তালিকাও রয়েছে।