ভাঙ্গাচোড়া বেড়িবাঁধে অরক্ষিত উপকূল।আজ থেকে বৃষ্টি কমতে পারে আরেকটি নিম্নচাপের হুমকি

0

রফিকুল ইসলাম থাকতেন সাতক্ষীরার দেবহাটার বহেরা গ্রামে। ৫৫ বছর বয়সে সম্প্রতি মারা যান। তার আত্মীয়রা তাকে বেহেরা পোস্ট অফিসের পিছনে কবরস্থানে সমাহিত করেন। পানির সঙ্গে লড়াই করে জীবন কাটিয়ে দেওয়া রফিকুলের মৃত্যুর পরও লড়াই থামছে না। গত মঙ্গলবার বিকেলে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তার লাশ ভেসে যায়। পচা লাশের গন্ধ সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। পরে আবার লাশ দাফন করা হয়।

গ্রামের বাসিন্দারা জানান, এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। বর্ষা-পূর্ণিমা তাদের কাছে আসে ভয়ঙ্কর রূপে। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। সবাই পানিতে ভাসছে। পানি কমে গেলে ঘর পরিষ্কার করার চেষ্টা শুরু হয়। তার পর আবার পানি ঢুকে যায়।

ভাঙা বাঁধের এমন দুঃখ শুধু বহেড়া গ্রামের নয়, ভুগছে দেশের উপকূলীয় এলাকার লাখো বাসিন্দা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ১৭ হাজার ৭০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৭,০০০ বাঁধ উপকূলীয় এলাকায়। এগুলো পুরাতন এবং বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙ্গে গেছে। বেশিরভাগ ডেকের যথাযথ সংস্কার করা হয়নি। ফলে পুরো উপকূলীয় এলাকা এখন অরক্ষিত।

নিম্নচাপ ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে গত চার দিনে দেশের ১৫টি জেলার হাজার হাজার গ্রাম ভাসছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জোয়ারের পানির উচ্চতা আগের চেয়ে বেশি। সরকারের পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। ফলে বাঁধ ভেঙে বা উপচে পড়ছে।

এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ সুস্পষ্ট নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে বুধবার সারাদেশে বৃষ্টি হলেও আজ বৃহস্পতিবার তা কমবে। যে কোনো জায়গায় সূর্যের মুখ দেখা যাবে। তবে আগামীকাল শুক্রবার থেকে আরেকটি নিম্নচাপ থাকবে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। আজ থেকে বৃষ্টি কমে গেলেও জোয়ারের চাপে উপকূলীয় অনেক গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ দুর্বল নাকি জোয়ারের চাপ বেশি তা প্রশ্ন উঠেছে।

নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে উপকূলীয় মানুষের জীবনযাত্রা ও দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ করে আসছে। সংস্থার গবেষক মুহাম্মদ ফররুখ রহমান বলেন, উপকূলীয় বাঁধগুলো কয়েক দশক ধরে অরক্ষিত। ফলে উপকূলীয় জনপদের রক্ষায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন।

বাগেরহাটে জোয়ারের পানিতে অন্তত আট হাজার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা মৎস্য অধিদফতরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তিন কোটি টাকা। এ ছাড়া বেড়ার পাড়ে ও ক্ষেতের সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

সাতক্ষীরার কয়রায় কপোতাক্ষ নদীর তীরে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত গুচ্ছগ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সাতক্ষীরা-২ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, কয়রার ১২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতি বছর ১০-১৫ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত করা প্রয়োজন। স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছায় দুই ঘণ্টার জন্য সর্বশেষ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেখানে জিওব্যাগ, বাঁশ ও জিওটেক্সটাইল সরবরাহ করতে পাউবো ১০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, গত ১০ বছরে জরুরি কাজের নামে কয়রা বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৮ হাজার টাকা। . তবে সেসব তালিকার মধ্যেও বাঁধ সংস্কারের নামে যত কাজই হোক না কেন, সেখানেও রয়েছে আমলা-কর্মকর্তা-জনপ্রতিনিধি-ঠিকদারদের সরকার ও জনগণের টাকা লুটপাট করার একটি অসাধু চক্র।

সাতক্ষীরার ৩৫টি পয়েন্টে প্রায় ৬২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। গত সোমবার আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের দক্ষিণ গদাইপুর গ্রামে খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে নদীর পানি বিল ও লোকালয়ে প্রবেশ করে।

গত কয়েকদিনের বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে বরগুনার ছয় উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। ফসলের ক্ষতি হয়েছে, মাছ ভেসে গেছে। বরগুনা, বেতাগী, পাথরঘাটা, আমতলীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্লাবিত হওয়ায় জনজীবনে দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। বেতাগী উপজেলার সরিষামুড়ি ইউনিয়নের কালিকাবাড়ি গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরগুনা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ৮০৫ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ কিলোমিটার ১২ ফুট বা তার কম উচ্চতায় এবং বাকি ৫০০ কিলোমিটারের গড় উচ্চতা ১৩ ফুট বা তার বেশি। ফলস্বরূপ, যখন জোয়ারের পানি ১২ ফুটের বেশি উচ্চতায় প্রবাহিত হয়, তখনই বাঁধটি এসব এলাকায় পানি উপচে পড়ে।

পিরোজপুরের শরিকতলা-ডুমুরটিলা ইউনিয়নে ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ থাকলেও সিডারে ভাঙছে মাত্র ৮ কিলোমিটার। যেহেতু বাঁধটি এখনো মেরামত হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *