নদী-প্যারাবনের মালিক ১৫৭ প্রভাবশালী
ছোট প্লট, ছোট ঘর। সবুজের ভিতর লাল ইটের দেয়ালে চোখ আটকে যাবে। প্লটের সামনে ঝুলছে কারও সাইনবোর্ড। পুরনো চেনা ছবি আর নেই। দখলদাররা এখন একদিকে বাঁকখালী নদী, অন্যদিকে প্যারাবন নিয়ন্ত্রণ করছে। দখলদারদের খপ্পরে ৬০০ হেক্টর প্যারাবন। সাত কিলোমিটার নদীর পাড়ে হাঁস-মুরগির খামার, দোকানপাট, চালের আটার মিল ও ঘরবাড়ি। দখলদারদের কেউ কেউ নদী-প্যারাবনের জমি নিজেদের মতো করে ব্যবসা করছে। ইচ্ছে করলে নদী ও বনে প্লট কেনা যায়। প্রতিটি প্লটের দাম ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। দখলদাররা সরকারি জমি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরছে।
কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর ৯ কিলোমিটার গভীরে দখলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নদী ও বনাঞ্চলে দিন দিন দখল বাড়ছে। দখলদারদের তালিকায় রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতা, পৌর মেয়রসহ একাধিক জনপ্রতিনিধি। পৌর কর্তৃপক্ষ নিজেরাই নদীটিকে আবর্জনার স্তূপে পরিণত করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা ও হাইকোর্টের নির্দেশেও থামছে না নদী-বন নিধন। বাকরুদ্ধ বাঁকখালী, নীরব প্যারাগন দেখে দখলদারদের চোখ লাল হয়ে যায়।
পরিবেশবিদরা বলছেন, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড় থেকে উৎপন্ন বাঁকখালী নদী কক্সবাজার শহরের উত্তর দিক দিয়ে রামুর ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মহেশখালী চ্যানেলে মিলিত হয়েছে। বাঁকখালীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ কিলোমিটার। এক দশক আগে ওই নদীর তীরে প্যারাবন (ম্যানগ্রোভ) তৈরি হয়েছিল। ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূল রক্ষা করার জন্য বনটি একটি প্রহরী হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে ফড়িং-এ হারিয়ে যাচ্ছে বন ও নদী। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা।
দখলের নেপথ্যে যারা ক্ষমতায় আছেন: বাঁকখালী ও প্যারাবন দখলের সঙ্গে জড়িত ১৫৭ জনকে শনাক্ত করেছে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতর। দখলের অভিযোগে দুটি মামলাও করেছে অধিদপ্তর। মামলার তিন আসামি হলেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এসএম আতিকুর রহমানের তিন ছেলে মিজানুর রহমান, এসএম কফিল উদ্দিন ও জসিম উদ্দিন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কস্তুরঘাট এলাকা তিন ভাইয়ের দখলে নিয়ে প্যারাবনের গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। মামলায় কক্সবাজার জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি (সম্প্রতি বহিষ্কৃত) ও খুরুস্কুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান সিদ্দিকী, তার ভাই খুরুসকুল ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম সিদ্দিকী, তাদের আত্মীয় আদনান সাউদ ও জসিম উদ্দিনের নাম রয়েছে। আসামি হিসেবে স্থানীয় প্রভাবশালী মো. সোহেল, আমিনুল ইসলাম আমান, মোহাম্মদ সেলিম ও ওমর ফারুকের নাম থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো তাদের দখলদারিত্ব ছড়িয়ে পড়ছে।
দখলদার তালিকায় মেয়র : কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান, জেলা প্রশাসনের গঠিত নদী সংরক্ষণ কমিটির সদস্য মো. সেই ‘নদী রক্ষাকারী’ নদী ধ্বংস করছে। মেয়রের নির্দেশে বাঁকখালী নদীর তীরে একাধিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশ না মেনে প্রতিদিন নদীতে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। সম্প্রতি নগরীর কস্তুরাঘাট, পেশকারপাড়া ও নানিয়ারছড়া ঘুরে দেখা গেছে, পৌরসভার ট্রাকে করে নদীতে ফেলা হচ্ছে বর্জ্য।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দখলদারদের তালিকায় প্রথমে পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানের নাম উঠে আসে। নতুন বাহারছড়া এলাকায় বকখালী নদীর তীর এক যুগ ধরে দখল করে বেশ কয়েকটি ছোট ঘর ও গুদাম তৈরি করেন আওয়ামী লীগ নেতা। বিআইডব্লিউটিএ ও পৌরসভার কর্মকর্তা ও স্থানীয়রা জানান, মজিবুর ছোট ঘর ও গুদাম ভাড়া নিয়েছিলেন।
বিআইডব্লিউটিএ-এর ২০২০ সালের ১৩০ জন দখলদারের সর্বশেষ তালিকায় মেয়র মুজিবুরও ছিলেন। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাশেদুল হক রাশেদও ছিলেন তালিকায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) ২০১৪ সালে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট কক্সবাজার প্রশাসনকে নদী দখলকারীদের তালিকা প্রকাশের নির্দেশ দেয়। একইভাবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জরিপ করে দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা নিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশও দিয়েছে হাইকোর্ট।