স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন।বাঙালির আনুষ্ঠানিক যাত্রা

0

১০ এপ্রিল, ১৯৭১। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তাৎপর্যপূর্ণ দিন। বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় ২৫ মার্চ, যেদিন পাকিস্তানি হানাদাররা পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশ) গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) নির্বাচিত করে সরকার গঠন করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন। যাদের নিয়ে এই সরকার গঠিত হয়েছিল তারা সবাই ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। আর এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার পথচলা শুরু হয়।

জনগণের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়নের পথে সরকারকে তিনটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। একদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বিশ্ব জনমত গঠনের মাধ্যমে স্বীকৃতি অর্জন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই তিনটি বিষয়ে কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন। ১০ এপ্রিল সরকার গঠনের পর, ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সরকার মুজিবনগর সরকার নামেই বেশি পরিচিত।

১০ এপ্রিল, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি মন্ত্রিসভার অন্য তিন সদস্য নির্বাচিত হন। তারা হলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ (পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ), এম মনসুর আলী (অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প) এবং এএইচএম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও কৃষি)। পরের দিন, তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম বেতার ভাষণ দেন, যা স্বাধীনতাকামী বাঙালি ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতিতে বিশ্ব জনমত গঠনের আশার আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে।

জাতির উদ্দেশে তার প্রথম ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের সাহসী ভাই-বোন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত  কোটি মুক্তিকামী জনতার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে, আমার সংগ্রামের জন্য আমি আপনাদের অভিনন্দন জানাই। ” তিনি আরও বলেন, “পাহাড়ের মতো লাশের নিচে পাকিস্তানের কবর তৈরি করা হয়েছে। একটি নতুন জাতি জেগে উঠেছে। ’ বক্তৃতা শেষে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘যারা রক্ত ​​দিয়ে বাংলাদেশের মাটিকে উর্বর করেছে আজ যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষের উত্থান হচ্ছে, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’।

এ ভাষণে তিনি দেশব্যাপী পরিচালিত প্রতিরোধ যুদ্ধের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি স্থানে স্থাপন করা হয়েছে (কৌশলগত কারণে অবস্থান ঘোষণা করা হয়নি)। তিনি ১৭ এপ্রিল মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের তারিখও ঘোষণা করেন। এরপর প্রবাসী সরকার ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকে আইনগতভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করে। পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেপ্তার করে তারা। গ্রেফতারের ঠিক আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ওয়ারলেসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বাণী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তাজউদ্দীন আহমদসহ লাখ লাখ বাঙালি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকেই ভারতের কলকাতার থিয়েটার রোডের একটি বাড়িতে মুজিবনগর সরকার গঠন হয়, যেটি ছিল যুদ্ধকালীন সরকারের সদর দপ্তর। ৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। পরের দিন তাদের বৈঠক হয়। দুই দিনের আলোচনায় চারটি বিষয় প্রাধান্য পায়। এগুলো ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বিশ্ব জনমত গঠন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও নিরাপত্তা এবং ভারতের সার্বিক সহযোগিতা এবং উদ্বাস্তুদের আশ্রয় নিশ্চিত করা। ফলপ্রসূ আলোচনার পর ৭ এপ্রিল জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তিস্তা নদীর উৎসস্থলে জঙ্গলে পাহাড়ি ঝরনার তীরে তাঁবু স্থাপনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সরকার গঠিত হয় এবং তার যাবতীয় কর্মকাণ্ডের অনুমোদন দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লেখা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *