রাস্তার ধুলোয় বিপর্যস্ত জীবন ঘরে থাকা দায়।দুর্দশার শহর গাজীপুর
মহাসড়কের দুই পাশে ভবনের সারা শরীরে ধুলার আস্তরণ। একই অভ্যন্তরীণ আসবাবপত্র এবং আনুষাঙ্গিক সত্য. ধুলোর স্তরটি সরানো হোক বা না হোক, এটি তার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। রাস্তার ধুলোর দাপট দেখে মনে হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর! গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা, টঙ্গী, চেরাগালী, বোর্ড বাজার, মালেকের বাড়ি, তেলিপাড়া বা স্টেশন রোড এলাকায় এমন দৃশ্য দেখা যায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে সালনা পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় ধুলোয় লাখ লাখ বাসিন্দার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বোর্ডবাজারের বাসিন্দা আব্দুল করিম আক্ষেপ করে বলেন, এত যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে পারবেন না। তিনি বলেন, রাস্তায় বের হলে পাঁচ মিনিটের দূরত্ব যেতে দুই ঘণ্টা লাগে! বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধের পথে। শরিফুল ইসলামের বাড়ি চেরাগালী এলাকায় সুরতরং রোডের ভেতরে। হাইওয়ে থেকে তার বাসায় যেতে প্রায় আধা মিনিট লাগে। তিনি বলেন, বাড়িটি মহাসড়কের পাশে হওয়ায় বাড়িটি ধুলোয় ভরে গেছে। বাড়ির লোকজনেরও সর্দি-কাশি। দত্তপাড়া এলাকার কফিল উদ্দিন রোডের বাড়িওয়ালা রফিকুল ইসলাম বলেন, বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধ শেষ। হোসেন মার্কেট এলাকার চায়ের দোকানদার মনোয়ারা বেগম জানান, চা বিক্রি করেই তার সংসার চলে। সড়কে ধুলার কারণে ব্যবসা করতে সমস্যা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। চেরাগালী এলাকার ব্যবসায়ী রাকিব কোকরিজের মালিক মিজানুর রহমান জানান, প্রতিদিন অনেকেই দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে আসেন। তারা এসে দেখে যে জিনিসের উপর ধুলোর আস্তরণ পড়ে আছে। তা দেখে কেনা তো দূরের কথা, কিছু না বলে চলে যান! দর কষাকষির পর দু-একজন বললেন, এগুলো অনেক পুরনো। তিনি বলেন, এখন যা ব্যবসা হচ্ছে তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন।
মাহাবুব অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক মাহাবুব জানান, সকালে দোকান খুলে জিনিসপত্রে ধুলার আস্তরণ পড়ে থাকতে দেখা যায়। বেলা পরিষ্কার করার সাথে সাথে চলে যায়। এ কারণে হাঁপানিসহ নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। বিক্রমপুর ভাগ্যকুল মিষ্টি ভান্ডারের স্বপন ঘোষ বলেন, “আমি কয়েক বছর ধরে চেরাগালীতে ব্যবসা করছি। কিন্তু এখন ধুলার কারণে বেচাকেনা হচ্ছে না। কাঁচের ফ্রেমে মিষ্টি রাখা হয়। কিন্তু তার মধ্যেও ধুলো আসে। যারা সকালের নাস্তা করতে আসে তাদের মুখে রুটি দিয়ে ধুলো লাগে। তখন অনেকে নাস্তা না করে চলে যায়। এ কারণে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
গাজীপুরে বায়ু দূষণের খবর বেশ পুরনো। বর্তমানে সেই দূষণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ কারণে শ্বাসকষ্ট, হাঁচি-কাশিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এলাকাবাসী। টঙ্গীর কলেজগেট এলাকার বিসমিল্লাহ ফাস্টফুডের মালিক মোশাররফ হোসেন বলেন, ধুলাবালুর মধ্যে শারীরিক, মানসিক ও ব্যবসায়িক বিপর্যয় নেমে এসেছে। আমি ইতিমধ্যে একটি ঠান্ডা ছিল. ধুলার কারণে বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে তাকে।
গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। প্রতিদিন অন্তত দেড় শতাধিক মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছেন। অথচ ছয় মাস আগেও এ সংখ্যা ছিল ১০-২০ জন।
গাজীপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন এলাকায় বায়ু দূষণের অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
গাজীপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নয়ন মিয়া বলেন, বাতাসে দূষণের পরিমাণ এত বেশি থাকলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধবে। তিনি বলেন, গাজীপুর সিটিতে ১৭টি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে। ইটভাটা থেকে আর বায়ু দূষণ হবে না। এছাড়া বায়ু দূষণের আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ঢাকনা ছাড়াই খোলা জায়গায় বালু, মাটি, ইট, পাথর, সিমেন্ট ও বর্জ্য যানবাহন চলাচল। এতে ধুলাবালি উড়িয়ে বায়ু দূষিত হচ্ছে। আর গাজীপুরে চলাচলকারী অধিকাংশ যাত্রীবাহী বাসের ফিটনেস নেই। ফলে সেগুলো থেকে নির্গত বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ধুলার সঙ্গে মিশে বাতাসকে আরও দূষিত করে।