গণতন্ত্রের নতুন যাত্রায় বিশ্বকে পাশ্বে চায় বাংলাদেশ
ছাত্র-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল সংস্কারে সম্ভাবনার এক নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। টেকসই সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্র, সুশাসন ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নতুন বাংলাদেশ গড়ার ইচ্ছা রয়েছে। বাংলাদেশ চায় বিশ্ব তার গণতন্ত্রের নতুন যাত্রাকে সমর্থন করুক। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্খাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।
গতকাল নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস এ আহবান জানান। ভাষণটি জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। তিনি বাংলায় ভাষণ দেন।
বাংলাদেশ সরকার প্রধান হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেন। তিনি পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব গ্রহণ, বাংলাদেশের জন্য জনগণের আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। তিনি দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের দায়িত্বের কথাও উল্লেখ করেন। তার বক্তব্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমসাময়িক বিষয় তুলে ধরেন এবং ভবিষ্যতের বিশ্বের কথা উল্লেখ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ছাত্র-অভ্যুত্থান
বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট মাসে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমি বিশ্ব সম্প্রদায়ের এই মহান সংসদে যোগ দিতে পেরেছি। আমাদের জনসাধারণের, বিশেষ করে যুবসমাজের বিপুল শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানের আমূল পরিবর্তনের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।’
ড. ইউনূস বলেন, ছাত্র-যুবদের আন্দোলন ছিল মূলত বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন। ধীরে ধীরে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর সারা বিশ্ব বিস্মিত হয়ে দেখেছে, বাংলাদেশের সমগ্র জনগণ কীভাবে রাজপথে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বৈরাচার, নিপীড়ন, বৈষম্য, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন যে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তি এসেছে শিক্ষার্থীদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে। তিনি বলেন, এই সম্মিলিত সংকল্পের মধ্যেই দেশের ভবিষ্যৎ নিহিত রয়েছে, যা বাংলাদেশকে বিশ্ব সম্প্রদায়ে একটি দায়িত্বশীল জাতির মর্যাদায় উন্নীত করবে।
ড. ইউনূস বলেন, এই গণআন্দোলন বাংলাদেশের বিশাল জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে যারা রাজনৈতিক অধিকার ও উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত। মানুষ একটি সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিল, যার জন্য নতুন প্রজন্ম তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিল। তিনি বলেন, “আমাদের তরুণেরা উঠে দাঁড়িয়েছে এবং গুলির সামনে দাড়িয়ে ছিল। আমাদের তরুনীরা বেআইনি রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে জোরালোভাবে সোচ্চার হয়েছে। স্কুলগামী কিশোরীরা বিনা দ্বিধায় তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। শত শত মানুষ চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। আমাদের মা, দিনমজুর এবং এই গণআন্দোলনে শহরের অগণিত মানুষ তাদের সন্তানদের কাঁধে তুলে নিয়েছিল, যতদূর আমরা জানি, আমরা স্বৈরাচারী শক্তির হাতে ৮০০ রও বেশি প্রাণ হারিয়েছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকে। ১৯৭১ সালে আমাদের জনগণ যে মূল্যবোধের জন্য লড়াই করেছিল তা আমাদের “জেনারেশন জি” বছর পরে নতুন করে শিখিয়েছে। এটা আমরা দেখেছি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যখন বাংলা মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে আগামী দিনে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করবে।
ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সাম্প্রতিক বিপ্লবের সময় বাংলাদেশের সাহসী সশস্ত্র বাহিনী ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়ে তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণে জনগণের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে শান্তির প্রতি তাদের অঙ্গীকার আরও একবার প্রমাণ করেছে। তিনি বলেন, “শান্তির প্রতি আমাদের অঙ্গীকারের কেন্দ্রবিন্দুতে মানবাধিকার স্থাপনের মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়েছে,” ।
ড. ইউনূস বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অবদান রাখা চতুর্থ বৃহত্তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৪৩টি দেশের ৬৩টি মিশনে শান্তিরক্ষী পাঠিয়েছে। ১৬৮ বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী এই মিশনে সেবা করার সময় তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে একইভাবে অবদান রাখার সুযোগ পাবে।