সুগন্ধা ট্র্যাজেডি।স্বজনদের ভেজা চোখ প্রিয় মুখ খুঁজছে
ঢাকা থেকে বরগুনাগামী ‘অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের দ্বিতীয় দিনেও শনিবার নতুন কোনো লাশ উদ্ধার হয়নি। তবে নিখোঁজ যাত্রীদের উদ্ধারে বরিশাল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডুবুরিরা সুগন্ধা নদীতে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে নদীতে বরিশাল কোস্টগার্ডের সদস্যরা টহল অব্যাহত রেখেছেন। এদিকে প্রিয়জনের মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত জেনে লাশের সন্ধানে দিনরাত সুগন্ধা নদীর পাড়ে কাটাচ্ছে স্বজনরা।
লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঝালকাঠি সদর থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় গঠিত তিনটি কমিটি গতকাল থেকে তদন্ত শুরু করেছে।
লঞ্চ অগ্নিকাণ্ডে নিহত বরগুনার ২৩ জনের মরদেহ শনাক্ত না হওয়ায় ২১টি কবরে দাফন করা হয়েছে। শনিবার দুপুরে বরগুনা সদর উপজেলার পটকাখালী এলাকায় খাকদন নদীর তীরে মরদেহগুলো দাফন করে জেলা প্রশাসন। এর আগে শুক্রবার রাতে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৭ জনের মরদেহ গ্রহণ করেন বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন।
এর মধ্যে ১৪ জনের লাশ শনাক্ত করেছেন স্বজনরা।
অপমৃত্যু মামলা: লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শনিবার সকালে ঝালকাঠি সদর থানায় একটি অপমৃত্যু (ইউডি) মামলা হয়েছে। ঝালকাঠি সদর থানার ওসি খলিলুর রহমান জানান, পোনাবালিয়া ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ সদস্য মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এ মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে দায়ী কোনো ব্যক্তির নাম বেরিয়ে এলে তাদের আসামি করা হবে।
কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি : লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তিনটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। শনিবার লঞ্চটি পরিদর্শনে কমিটির সদস্যরা ঝালকাঠিতে আসেন। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল হাসান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া এবং ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নাজমুল আলমের নেতৃত্বে তিনটি কমিটি তদন্ত শুরু করে। এ সময় তারা লঞ্চের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখেন, প্রত্যক্ষদর্শী ও যাত্রীদের হেলপারদের সঙ্গে কথা বলেন।
তদন্ত প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব তোফায়েল হাসান বলেন, “আমরা লঞ্চটি পরিদর্শন করেছি। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। লঞ্চটি যেখানে থেমেছে আমরা সেখানেও যাব। নৌপরিবহনের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে কথা বলব। লঞ্চের নথিপত্রও যাচাই-বাছাই করা হবে।এছাড়া আমরা এই দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখব এবং কারও দায়িত্বে অবহেলা বা ব্যর্থতা আছে কি না।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির প্রধান উপ-পরিচালক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ছয়টি সিলিন্ডারের মধ্যে একটি বিস্ফোরণ হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঝালকাঠির সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির সদস্য প্রশান্ত কুমার দে জানান, পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি দিয়াকুল থেকে ঝালকাঠি লঞ্চ টার্মিনালে আনা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে সেটি এখন পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে।
এদিকে, পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শন শেষে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাহজাহান খান বলেন, এরপর আগুন পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে।
দোয়া ও ভালোবাসায় বিদায় : বরগুনায় লঞ্চ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৩৭ জনকে দোয়া, ভালোবাসা ও চোখের জলে বিদায় জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। শনিবার বিকেলে নগরীর সার্কিট হাউস ঈদগাহ মাঠে ৩০ জনের জানাজা শেষে অজ্ঞাত ২৩ জনের লাশ পোটখালী গণকবরে দাফন করা হয়। বাকি ১৪ জনের লাশ শনাক্ত করে তাদের স্বজনরা নিয়ে গেছে। মায়ের কোলে থাকা অবস্হায় দুই শিশু দগ্ধ হয়। তাদের আলাদা করা সম্ভব না হওয়ায় দুটি কবরে চারজনকে দাফন করা হয়। বাকি ১৯ জনকে আলাদা কবরে দাফন করা হয়েছে।
এ সময় স্বজনদের আহাজারি ও উপস্থিত লোকজনের কান্নায় পুরো এলাকায় এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তবে কতজন এখনো নিখোঁজ রয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। নিখোঁজদের সংখ্যা নির্ধারণে একটি সেল গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।
বরগুনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ঝালকাঠি হাসপাতাল থেকে ৩৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে বরগুনা জেলা প্রশাসন। রাজ্জাক মাস্টার, বেতাগীর রিয়াজ হাওলাদার ও বামনার স্বপ্নিল নামে তিনজনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতাল থেকে তাইফা নামের এক শিশুর মরদেহ বরগুনা সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের রোদপাড়া এলাকায় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে প্রশাসন। পরে শুক্রবার রাত ১২টার দিকে জাহানারা নামে এক নারীর লাশ তার জামাই স্বপনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
শনিবার বিকেলে দাফনের আগে নিখোঁজ স্বজনদের লাশ বেঁধে বাকি মরদেহ কফিনবন্দি করে সদর হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়।