একের পর এক পর্যটকের মৃত্যু, কেউ দায় নিচ্ছে না

0

পানি আয়নার মত স্বচ্ছ। পানির নিচের পাথর এবং বালি খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যায়। এমন সৌন্দর্য আরও কাছে উপভোগ করতে অনেক পর্যটক নদীতে নেমে যান। এখানেই দুর্ঘটনা ঘটে। প্রবল স্রোত, স্রোত ভেসে যাওয়া, নৌকা ডুবে যাওয়া এবং সাঁতার না জানার কারণে পর্যটকরা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য জাফলং ও সাদা পাথরে একের পর এক ঘটছে এমন দুর্ঘটনার দায় কেউ নিচ্ছে না। উল্টো পর্যটকদের দোষারোপ করছে কর্তৃপক্ষ।

পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য কোনো নির্দেশনা না থাকায় এবং সঠিকভাবে জানানো না হওয়ায় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ যেমন সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড, স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ, লাইফ জ্যাকেট সরবরাহের পাশাপাশি পর্যটকদের দায়িত্ব ও থানা পুলিশ মৃত্যু রোধ করতে পারে না।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পর্বত অবলম্বন দুটি স্থানীয় নদী, পেইন এবং ধলাই নদীর সাথে যুক্ত। পর্যটন কেন্দ্র জাফলং সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাথর ও বালু উত্তোলনের ফলে মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত দুই দশকে এখানে ৫৯ জন পর্যটক মারা গেছেন। অপরদিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষে শ্বেতপাথরের পর্যটন কেন্দ্র যেন এক শিল্পীর আঁকা দৃশ্য। ৫-৬ বছর আগে ভোলাগঞ্জের ধলাই নদীর তীরে এই পর্যটন কেন্দ্রটি পরিচিতি পায়। এরপর বাড়তে থাকে পর্যটকের সংখ্যা। এরই মধ্যে সেখানে ১১ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া জেলার আরেক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দিতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে। নিহতদের অধিকাংশই সিলেটের বাইরের পর্যটক। অতি সম্প্রতি, সাদা পাথরে সালাম নামে এক যুবক এবং ৬ জুলাই জাফলংয়ে জাওয়াজ আল আরশ নামে এক স্কুলছাত্র মারা যায়।

জানা যায়, পর্যটন কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণে কোনো একক কর্তৃপক্ষ নেই। একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব রয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রের উন্নয়নসহ বিভিন্ন দিক দেখাশোনা করে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো পর্যটন উন্নয়ন কমিটি পরিচালনা করে। এর সভাপতি জেলা প্রশাসক। এ কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা অপ্রতুল। এমনকি পর্যটকরাও সেসব নির্দেশ মানছেন না। গত কয়েক বছর ধরে ট্যুরিস্ট পুলিশ যুক্ত হওয়ায় তারা পর্যটকদের নিরাপত্তায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ ও পর্যটকদের জন্য লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

পর্যটকদের অভিযোগ, দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যুরিস্ট পুলিশ বা স্বেচ্ছাসেবকরা কোন পর্যটন কেন্দ্রে হাজার হাজার পর্যটকের যাওয়া বা সাঁতার কাটতে না পারে সেদিকে কোন নির্দেশনা দেন না। মাঝেমধ্যে মাইকিং করা হয় এবং কোথাও কোথাও সাইনবোর্ড টানা হয়।

শুক্রবার শ্বেতপাথর পরিদর্শনে আসা সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ছাত্র মাহফুজ জানান, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ সিরিয়াস নয়। স্বেচ্ছাসেবক থাকলেও কেউ কোনো নির্দেশনা দিচ্ছেন না।

জেলা উন্নয়ন পর্যটন কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মজিবুর রহমান জানান, তারা পর্যটকদের সাধ্যমতো নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, নির্দেশনা না মানার কারণে অনেক পর্যটক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান বলেন, কেউ যেন গোসল করতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। পর্যটকদের জানানোর জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ হ্যান্ড মাইকের মাধ্যমে চব্বিশ ঘণ্টা প্রচারণা চালায়। কিন্তু অনেকেই সেদিকে মনোযোগ দেন না।

জাফলং ট্যুরিস্ট পুলিশের ওসি রতন শেখ বলেন, বিশেষ দিনে এত পর্যটক থাকায় ট্যুরিস্ট পুলিশের স্বল্প জনবল দিয়ে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। অসাবধানতা এবং নির্দেশনা না মানলে মাঝে মাঝে পর্যটকদের মৃত্যু হয় বলে তিনি মনে করেন।

সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি আবদুল হাই আল হাদি মনে করেন, পর্যটকদের মৃত্যু রোধে সচেতনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ অনেকেই বালু বা নদীর গভীরতা জানেন না। পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ ও নির্দেশনা প্রণয়নের মাধ্যমে পর্যটকদের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *