ধান ক্ষেতে লবণপানি, কৃষকের চোখে জল
সবিতা হালদার। পরিবারের সামান্য সচ্ছলতার জন্য তিনি ছয় বিঘা জমি কিনে গরু বিক্রির ৪০ হাজার টাকা এবং একটি এনজিওর ঋণ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ধান চাষ করেন। ফলনও ভালো হওয়ায় এ বছর ভালো হবে বলে তিনি আশাবাদী। কিন্তু তার স্বপ্ন লোনা পানিতে ডুবে গেছে।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার কালেরবেড় এলাকার সবিতা ধান সংগ্রহ করতে চেয়েছিলেন মাত্র ১৫ দিন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা খালের বাঁধ কেটে চিংড়ি চাষের জন্য নোনা পানি চালু করলে তার কষ্টার্জিত ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
সদর উপজেলার কাশিমপুর এলাকার সুজন শেখ চার বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন। কৃষি দফতর থেকে সাহায্য প্রাপ্ত ব্লকে তার জমি ছিল। তারও খরচ হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। কৃষি বিভাগের তৈরি সেচ লাইনের মাধ্যমে পানি দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার জমির ধানও মরে যায়। নোনা পানি যেমন নদীতে প্রবেশ করে, তেমনি সেচের লাইনেও প্রবেশ করে। সে ক্ষতির পথে আছে।
বাগেরহাটের তিন উপজেলার অন্তত ৪০টি এলাকায় একই চিত্র।
একদিকে চাষাবাদের সুপেয় পানির অভাব, অন্যদিকে প্রভাবশালীরা খালে লোনা পানি ঢুকিয়ে মাছ চাষ করছে। এতে গত এক মাসে তিন উপজেলায় অন্তত ১১০০ বিঘা ধান নষ্ট হয়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
রামপালের কৃষকরা ইউএনও, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দফতরে ১৫ দিন ধরে আবেদন করেও কোনো সুফল পাননি। উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের কালেখারবেড় এলাকায় জুলু হাজীসহ অন্যরা খালের বাঁধ কেটে মাছের ঘেরে পানি দেয়। শুধু কালেখরবার নয়, উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নের সিঙ্গুরবুনিয়া, রঞ্জয়পুর ও আড়ুয়াডাঙ্গা এলাকায় ব্যবসায়ীদের খাল কেটে লোনা পানি প্রবেশ করায় জমির ধান মরতে শুরু করেছে।
সদর উপজেলার ডেমা ও খানপুর ইউনিয়নের অন্তত ৩০০ বিঘা জমির ধান পচে গেছে। ডেমা ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া ও ছবাকি স্লুইস গেট দিয়ে ছবাকি নদীতে লোনা পানি প্রবেশ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই সময়ে, স্থানীয় হরিখালী ক্ষুদ্র পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি হরিখালী বরাবর তিনটি স্লুইস গেট থেকে পুটিমারী বিলে লোনা পানি প্রবেশ করায়। পুটিমারী বিলের অন্তত ২০০ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়েছে।
মোরেলগঞ্জে ধান কাটার ২০ দিন আগে একই পদ্ধতিতে মাছের ট্যাঙ্কে লোনা পানি তোলায় ৩০০ বিঘা ধান নষ্ট হয়েছে। ঘটনার বিচারের দাবিতে গত ২৭ মার্চ ধানক্ষেতের কাছে মানববন্ধনও করেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
রামপালের কৃষক হুমায়ুন কবির জানান, খালের বেড়িবাঁধ কেটে এলাকার নোনা পানি আনতে কৃষকরা। বাঁধ কাটার আগে চেয়ারম্যান, কৃষি কর্মকর্তা ও ইউএনওসিকে বিষয়টি অবহিত করেন। তিনি ধান কেটে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাত্র ১৫ দিন সময় চেয়েছেন। কিন্তু তাদের কথা কেউ শোনেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেমা ইউনিয়নের কয়েকজন কৃষক জানান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেনসহ স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ছবাকি ও বাঁশবাড়িয়া স্লুইস গেট দিয়ে লোনা পানি প্রবেশ করান।
তবে বিষয়টি অস্বীকার করে ডেমা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন দাবি করেন, কৃষকদের সম্মতিতে মাঘী পূর্ণিমার সময় গেট দিয়ে পানি চালু করা হয়। কারণ তখন পানি মিষ্টি ছিল। এরপর আর জল যোগ করা হয়নি।
মোরেলগঞ্জ কৃষি কর্মকর্তা আকাশ বৈরাগী জানান, প্রভাবশালীরা ঘেরে লোনা পানি তুলে দরিদ্র কৃষকদের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে।
রামপালের ইউএনও নজিবুল আলম জানান, ব্যবসায়ী ও কৃষকের মধ্যে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা সমাধানে স্থানীয় চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সদরের ইউএনও রুবাইয়া তাসনিম এসব গেট দিয়ে লোনা পানি যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম বিল্লাহ বলেন, লোনা পানি যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তারা গেট বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু রাতে কে গেট খুলে নোনা পানি ঢালে তা তারা জানে না। তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।