গরমের তেজ কমলে লোডশেডিং কমবে

0

অফিস শেষে যানজট ঠেলে মারজিয়া আক্তার তার পুরান ঢাকার বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সাড়ে ৭টার দিকে শিশুরা পড়ার টেবিলে বসার আগেই বিদ্যুৎ চলে যায়। লোডশেডিং এবং প্রচন্ড গরম তাদের পড়াশুনাকে কঠিন করে তোলে। মার্জিয়া চার্জ লাইটের আলোয় ঘরের অন্যান্য কাজ করত। রাত সাড়ে নয়টায় বিদ্যুৎ আসে। রাতের খাবার শেষ করে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুমাতে গেলে সাড়ে ১১টার দিকে আবার বিদ্যুৎ চলে যায়। গরমের তীব্রতায় ঘুমের মধ্যে সবাই হাঁপাচ্ছে। ক্লান্ত শরীরেও হাত পাখার বাতাস দিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়িয়ে দেন। রাত দেড়টার দিকে বিদ্যুৎ আসে। আবার চলে যান  ভোর ৪টায়। গত সোমবার রাতে লোডশেডিংয়ের অগ্নিপরীক্ষার শিকার হন মার্জিয়া আক্তার। সারাদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকার পরও রাতে এমন লোডশেডিংয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ। ঢাকায় দিনে-রাতে অন্তত চার ঘণ্টা এবং গ্রামে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী শিডিউল অনুযায়ী লোডশেডিং হতে যাচ্ছে, কিন্তু তা আর ঠিক হচ্ছে না।

বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির পর কয়েক বছর লোডশেডিং সেই মাত্রায় ছিল না। করোনাভাইরাস পরবর্তী চাহিদা বৃদ্ধি এবং ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বৈশ্বিক শক্তির বাজারগুলি অস্থির হয়ে উঠেছে। গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছে সরকার। খরচ বাঁচাতে জ্বালানি গ্যাস আমদানি কমায়। তেলের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শুরু হয়। এতে বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানি সংকট বাড়ে। গত এপ্রিল থেকে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়েছে। গত ১৯ জুলাই লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দেয় সরকার। সেপ্টেম্বরে কিছুটা কমলেও অক্টোবরের শুরু থেকে পরিস্থিতি আবার খারাপ হয়। বর্তমানে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মঙ্গলবার বলেন, ‘আমি আশা করেছিলাম সেপ্টেম্বর থেকে লোডশেডিং কমবে। এটা ঘটেনি। বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখনও অনুকূল নয়। দাম বাড়ায় গ্যাস আনা যাবে না। ডলার সংকট ও পিডিবির কাছে বকেয়া বিলের কারণে বেসরকারি কেন্দ্রের তেল আমদানি কমেছে; উৎপাদন কমে গেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে না। দিনে চলাচলকারী তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রাতে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। শিল্পকে আরও গ্যাস দিতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। তাই লোডশেডিং বন্ধ করা যায়নি। নভেম্বরের আগে ভালো খবর নেই।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. তামিম  বলেন, ‘জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন কমছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম না কমলে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ১০০ ডলারের নিচে থাকলেও পরিশোধিত জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেলের দাম আবার বেড়েছে। পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বলেন, কয়েকদিন আগে ব্যারেল প্রতি ডিজেলের দাম ১১০ ডলারে নেমেছে। এটি আবার  ১৪০ এর উপরে উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যেভাবে চলছে তাতে তেলের দাম কমার সম্ভাবনা কম।

লোডশেডিং বৃদ্ধির নেপথ্যে: উৎপাদন কমে যাওয়ায় জুলাইয়ের তুলনায় অক্টোবরে লোডশেডিং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জুলাই-আগস্টে দৈনিক গড় লোডশেডিং ছিল ২০০০ মেগাওয়াট। এখন এর পরিমাণ তিন হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। এর প্রধান কারণ গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়া। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২২৫ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে পেট্রোবাংলা গড়ে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে।

জুলাই মাসে গ্যাস সরবরাহ ছিল প্রতিদিন ২৮০ থেকে ২৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়া যায় ৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। গত কয়েক দিনে ৩৮০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি পাওয়া গেছে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, এলএনজি কার্গো আসা কমে যাওয়ায় সরবরাহ কমেছে। তিনি বলেন, আগের তিন মাসে পাঁচটি এলএনজি কার্গো এসেছে, কিন্তু অক্টোবরে আসবে মাত্র চারটি।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমেছে। এখানে দুটি জিনিস ঘটছে। এক, খরচ বাঁচাতে সরকার কম তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাচ্ছে। দুই, ফার্নেস অয়েল সংকটের কারণে বেসরকারি খাতে উৎপাদন কমছে। বেসরকারি কেন্দ্র থেকে ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাওয়া যায়।

বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রর সংগঠন বিপ্পার সভাপতি ইমরান করিম বলেন, প্রায় চার মাসের বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ সরকারের কাছে ১৬ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। আর্থিক অনটনের কারণে অনেক মালিক ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারছেন না। ফলে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে তেল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এলসি খুলতে পারছেন না মালিকরা। ডলারের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের খরচও বেড়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *