বিজ্ঞান শিক্ষা প্রকল্পে ২৫১১ কোটি টাকার অনিয়ম

0

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ২ হাজার ৫১১ কোটি টাকার ‘সরকারি কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষা সম্প্রসারণ প্রকল্পে’ চলছে ব্যাপক অনিয়ম। গত জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও এখনও প্রায় ৭৮ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে। এখন পর্যন্ত নির্মাণাধীন ২০০টি ভবনের একটিও হস্তান্তর করা হয়নি। তবে নতুন ভবনের জন্য আসবাবপত্রসহ প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার কাজ থেমে নেই। এসব কিনতে গিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট পলিসি (পিপিআর) লঙ্ঘন করে সম্প্রতি প্রথম ছয়টির পর সপ্তম ও চতুর্থ দরদাতাকে আসবাবপত্র সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে কম দরদাতা হয়েও দেশের বড় ফার্নিচার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দেওয়া হয়নি। এ দুটি দরপত্রে সরকারের প্রায় এক কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। তবে প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকে কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের দামের পার্থক্য প্রায় দুই কোটি টাকা।

বিজ্ঞান শিক্ষার এই প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের ২৪ মার্চ কলেজের আসবাবপত্র সরবরাহের দরপত্র আহ্বান করা হয়। ২৭ এপ্রিল দরপত্র খোলা হয়। প্রায় ২ কোটি ৩১ লাখ টাকা দিয়ে প্রথম দরদাতা ছিল প্রমিক্সো লিমিটেড। পারটেক্স ফার্নিচার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২ কোটি ৯১ লাখ টাকায় দ্বিতীয় দরদাতা হয়। আখতার ফার্নিশার্স লিমিটেড তৃতীয় দরপত্রে ২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। আর চতুর্থ দরদাতা ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা হাতিল কমপ্লেক্স লিমিটেড। গত ২৯ জুন চতুর্থ দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

এর আগে গত বছরের শেষ দিকে আসবাবপত্র সরবরাহের জন্য আরেকটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। গত বছরের ১৮ নভেম্বর যখন দরপত্র খোলা হয়, প্রথম দরদাতা ছিল ডিজাইনটেক ইন্টেরিয়র অ্যান্ড ফার্নিশার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। তারা বিড করেছে ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। প্রমিক্সো লিমিটেড ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা দর দিয়ে দ্বিতীয় দরদাতা হয়েছে। আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেড এক কোটি ৭৯ লাখ টাকা দর দিয়ে তৃতীয় দরদাতা হয়েছে। অটবি লিমিটেড ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা দর দিয়ে চতুর্থ দরদাতা হয়েছে। কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড বিডি ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা দর দিয়ে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। অরনেট প্লাস ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে যার মূল্য ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সপ্তম স্থানে রয়েছে হাতিল কমপ্লেক্স লিমিটেডের দাম ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। কিন্তু সপ্তম দরদাতাকে কাজটি দেওয়া হয়।

পরপর দুটি দরপত্রে সপ্তম ও চতুর্থ দরদাতাকে কাজ প্রদানে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আবার দুটি দরপত্রে যেখানেই থাকুক একই কোম্পানিকে কাজ দেওয়ায় অভিযোগ আরও জোরালো হয়েছে।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ড. খন্দকার মুজাহিদুল হক  বলেন, এই দরপত্রে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আপলোড না হওয়ায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দরদাতাকে কাজ দেওয়া সম্ভব হয়নি। চতুর্থ দরদাতাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। পিপিআর অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

দ্বিতীয় ও তৃতীয় দরদাতাদের কাছে কোনো নথির ঘাটতি ছিল কিনা জানতে চাইলে উপ-প্রকল্প পরিচালক জেসমিন তাসমিলা বানু ও গবেষণা কর্মকর্তা ইব্রাহিম মিয়া বলেন, দ্বিতীয় দরদাতা পারটেক্স ফার্নিচার ফরেস্ট স্টুয়ার্ডশিপ কাউন্সিল-এফএসসি সার্টিফিকেট দেয়নি। তাদের অডিট রিপোর্টও হালনাগাদ করা হয় না। আর আখতার ফার্নিশার্স মালিকানার হলফনামা, কোম্পানির প্রোফাইল ও পণ্যের বারকোড দেয়নি। এ কারণে এ দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়নি।’

পারটেক্স ফার্নিচার ও আখতার ফার্নিসারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এই প্রকল্পের টেন্ডারে মোট ১৯ ধরনের নথি চাওয়া হয়েছিল, যার সবগুলো দেওয়া হয়েছে। আমাদের মতো কোম্পানির মালিকানা, কোম্পানির প্রোফাইল বা পণ্যের বারকোড নেই – এটা বলা হাস্যকর। কোম্পানির প্রোফাইল প্রত্যেকের ওয়েবসাইটে আছে। এ ছাড়া আমাদের কোম্পানির অডিট নিয়মিত আপডেট করা হয়। এফএসসি সার্টিফিকেটও আছে। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ অতীতে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করেছি।

নাম প্রকাশ না করে শিক্ষা বিভাগের সাবেক এক প্রকল্প পরিচালক বলেন, সবার আগে দেখা উচিত কম দামে ভালো পণ্য কেনা যায় কি না। পারটেক্স এবং আখতার উভয়ই ভাল কোম্পানি। তারা সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার পরে, যদি কোনও কাগজের অভাব পাওয়া যায়, তবে সেই কাগজটি চাওয়ার জন্য তাদের প্রাক-মিটিং করার সুযোগ ছিল। এটি পিপিআর-এও বলা আছে। কিন্তু তা না করে বারবার একই কোম্পানিকে কাজ দেওয়া মানেই বড় ধরনের অনিয়ম।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণত যে কোনো কেনাকাটায় কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো কমপক্ষে ৬ শতাংশ কমিশন দেয়, যা মূলত প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের পকেটে যায়। কিন্তু এই ৬ শতাংশ টাকাও নেওয়া হয় প্রথম বা দ্বিতীয় দরদাতার কাছ থেকে। কিন্তু দুটি বড় কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও চতুর্থ দরদাতাকে কাজ দেওয়ার পেছনে বড় ধরনের অনিয়ম থাকাটাই স্বাভাবিক।

প্রকল্প-সম্পর্কিত পক্ষগুলির মধ্যে একটি বিভাজন হতে পারে।

অবশ্য প্রকল্প পরিচালক মো. খন্দকার মুজাহিদুল হক বলেন, ‘কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো আর্থিক লেনদেন নেই। আমি চ্যালেঞ্জ করছি যে কোন আর্থিক লেনদেন হয়নি। এবার চতুর্থ দরদাতাকে কাজ দেওয়ার আগে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। আমি আমার পরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি যারা বড় ঠিকাদার। চতুর্থ দরদাতাকে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম লঙ্ঘন হয়নি। ছোট কোনো কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হয়নি। এত ভালো ফার্নিচার এর আগে কেউ দেয়নি।’

তিনি আরও বলেন যে সাংবাদিকরা তাকে এত ছোট বিষয়ে বিরক্ত করতে দেখে তিনি দুঃখিত। তিনি নিজেও সাংবাদিক ছিলেন। এত ছোট বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো সাংবাদিকদের কাজ নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *