গুম কমেছে, স্বজনদের কান্না থামেনি।আজ আন্তর্জাতিক গুম ব্যক্তি দিবস
দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনা হলেও গুম রোধে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। এছাড়াও, বাংলাদেশ গুম রোধে কাজ করছে বা আন্তরিক এমন কোনো বার্তাও সরকার সমাজকে দেয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহিতারও অভাব রয়েছে। সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ড এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে গুমের সংখ্যা কমলেও কান্না থেমে নেই। আন্তর্জাতিক গুম দিবসে এমনটাই মনে করছেন মানবাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। একই সঙ্গে গুমের শিকারদের পরিবার তাদের স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বন্ধ করছে না। তারা জানতে চায়- এর পেছনে কারা?
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে সরকার ব্যাচেলেটের গুম হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। জাতিসংঘের দেওয়া তালিকায় ৭৬ জনের নাম না পাওয়া নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাচেলেটকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।
সফরের শেষ দিনে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যাচেলেট বলেন, তিনি সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। সরকার কী করবে, সেটা সরকারের ওপর ছেড়ে দিলাম। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। সেগুলো সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় তদন্তের আহ্বান জানিয়েছি।
গুম রোধে মানবাধিকার কর্মীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। সরকার অস্বীকার করে প্রতিকার খুঁজছে। আর যতদিন গুম অস্বীকার করে যাবে, সরকারের কাছে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে না। গুম ব্যক্তিদের বিষয়ে সরকারের প্রতিটি ব্যাখ্যার জবাব রয়েছে। মামলার আসামিরা পলাতক, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কী মামলা- সরকার তা প্রকাশ করুক। যাদের ক্ষেত্রে প্রেমের কারণে পালাবার কথা বলা হয়, তখন প্রেমিকেরও উচিত সেই প্রেমিককে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। ওই প্রেমিক নিখোঁজ হওয়ার তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। যাদের ক্ষেত্রে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে, তখন এসব মানুষ কখন ও কীভাবে বাংলাদেশ ছেড়েছে সে বিষয়ে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। সরকার সেই তথ্য উপস্থাপন করুক। যারা ঋণগ্রস্ত বলে জানা গেছে, তাদের ঋণের সুনির্দিষ্ট তথ্যও সরকারের কাছে থাকতে হবে। সরকার এর কোনোটিই উপস্থাপন করছে না। উল্টো ধল্লা তাদের নিখোঁজ নিয়ে মন্তব্য করছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী মো. নূর খান বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে গুমের ঘটনা ঘটছে। পরিবার এবং সাক্ষীদের দ্বারা করা বিবরণ এবং দাবি থেকে, এই গুমের সাথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জড়িত বলে বিশ্বাস করার স্পষ্ট কারণ রয়েছে।
সরকার তা অস্বীকার করলেও বাংলাদেশে গুমের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত গুম রোধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সরকার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। কারণ যারা গুমের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছেন, তারা এটাকে আমলে নিচ্ছেন না, তারা এটা ঠেকাতে কী করবেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এই মানবাধিকার কর্মী।
এ বিষয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা। নূর খান বলেন, মেজর সিনহাকে হত্যার পর কয়েক সপ্তাহ গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমেছে। তারপর আবার ঘটনা চলতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের জলাতঙ্কের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর থেকে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমেছে, কিন্তু শেষ হয়েছে তা বলার উপায় নেই। নিখোঁজদের কয়েকদিন পর ছেড়ে দেওয়া, পুলিশে সোপর্দ করা বা আদালতে হাজির করা এখনও সাধারণ ঘটনা। জাতিসংঘ গুম প্রতিরোধে তদন্ত কমিশন গঠনে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আমাদের দাবি একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা, নিখোঁজের বিষয়ে জাতিসংঘের সনদে স্বাক্ষর করা এবং নিখোঁজের বিষয়ে জাতিসংঘের তদন্ত দলকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়া।
বাংলাদেশে গুমের সংখ্যা আগের চেয়ে কম বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গুমের হার বাড়লেও পরে তা কমতে শুরু করে। এই তথ্যে নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা ওঠানামা করে। অনেকেই মনে করছেন এই সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি পদক্ষেপ বা নানা সমালোচনা বা অন্য কোনো কারণে তা কমেছে কিনা তা গবেষণার বিষয়। দেশের ভেতরে ও বাইরে বড় ধরনের সমালোচনার কারণে হতে পারে।