‘আমি আমার সন্তানকে বিক্রি করতে চাইনি, ঘরে খুব অভাব’

0

‘আমি সন্তানকে খুব ভালোবাসি। ওকে অন্য কারো কাছে দিতে চাই না। কিন্তু আমি কাজ করতে পারি না। থাকার জায়গা নেই। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ধনী পরিবারে তাকে দত্তক নিতে চেয়েছিলাম। আমি বিক্রি করতে চাইনি। তবে দত্তকসহ কিছু টাকা পেলে আমার জীবনযাপনও মসৃণ হবে।’

অভাবের কারণে বাজারে বাচ্চা বিক্রির চেষ্টা করায় আলোচিত খাগড়াছড়ির সোনালী চাকমা বৃহস্পতিবার ঘটনার অসংলগ্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি গ্রামের পাকুয্যাছড়িতে বাবার বাড়িতে সন্তানকে নিয়ে এখন আছেন তিনি। ওই ঘটনার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তার পাশে দাঁড়ান। তাকে চাল-ডাল-তেলসহ কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ তাকে সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন।

অসুস্থতা ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে দুর্বল হয়ে পড়া মধ্যবয়সী সোনালী দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে খাগড়াছড়ি বাজারে যান তিনি।

একজন পরিচিত ব্যক্তি তার এলোমেলো ঘোরাঘুরি দেখে বুঝতে পারেন যে তিনি টাকার বিনিময়ে সন্তানকে দত্তক নিতে চান। এই তথ্য ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় এক বাঙালি দত্তক নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু জঙ্গল পাহাড়ের লোকজন তাতে বাধা দেয়। তাদের ভাষ্যমতে, কমলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুনীল জীবন চাকমার স্ত্রী রোজিনা চাকমা দীর্ঘদিন ধরে দত্তক নেওয়ার জন্য ছেলের খোঁজ করছিলেন। তাদের কেউ কেউ আবার সোনালীকে শিশু-কিশোর সন্দেহে হত্যার চেষ্টা করে। খবর পেয়ে রোজিনা চাকমা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আর্জেন্ট চাকমাসহ মাছ বাজারে যান। রোজিনার স্বামী সুনীল জীবন চাকমাও উপস্থিত ছিলেন। মা-ছেলেকে নিয়ে নগরীর মধুপুর বাজার এলাকায় যান তারা। পথিমধ্যে মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়ে জ্ঞান হারান গোল্ডেন। পরে তাকে তার ছেলেসহ দুপুরের খাবার দেওয়া হয়। একপর্যায়ে জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পানছড়ি থেকে মনোনীত সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য অনিমেষ চাকমা রিংকুও সেখানে হাজির হন। বিষয়টি ভাইবোনছড়া ইউপি চেয়ারম্যান সুজন চাকমাকে ফোনে জানালে তিনি সোনালীর বাবা-মাকে পাঠান। তারা এসে সোনালী ও তার ছেলেকে পাকুয্যাছড়ির বাড়িতে নিয়ে যায়। তখন উপস্থিত সবাই কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেন।

শনিবার কথা হয় অনিমেষ চাকমা রিংকুসহ উপস্থিত অন্যদের সঙ্গে। তারা বলেন, চাকমা সমাজে শিশু বিক্রির মতো জঘন্য ঘটনার নজির নেই। ঘটনাটি গণমাধ্যমে ভুলভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

জানা গেছে, সোনালী দীর্ঘদিন ধরে সন্তানের ভরণপোষণের জন্য একজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করছিলেন। সোনালীর ছোট ভাই ভরত চাকমা বলেন, আমার বড় বোন আসলে পাগল।

দেড় বছর ধরে ভাইদের আশ্রিত হয়ে বাবার বাড়িতে বসবাস করছিলেন সোনালী। তার বাবা কালবো চাকমা, মা কালবী চাকমা, ভাইয়ের স্ত্রী তুংকি চাকমা ও মমতা ত্রিপুরা ও মামী বীর রানী চাকমা জানান, এক বছর আগে সোনালী পানছড়ির প্রত্যন্ত শঙ্খখোলা গ্রামের ওজা বুজ্যা নামে এক বৃদ্ধ বৈদ্যকে চতুর্থবার বিয়ে করেন। সেই বাড়ির একমাত্র সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমা। সোনালি তার প্রথম বিয়েতে একক পরিবার রাখতে পেরেছিলেন, কিন্তু পরের তিনটি পরিবারে তিনি সাতজন বা বিপর্যস্ত স্বামীর আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। প্রথম ঘরের ছেলেমেয়েরা সচ্ছল হলেও তাদের কেউ খেয়াল রাখে না। ফলে সেখান থেকে আনা খাবার বা চাল-ডাল নিয়ে পাড়ার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতেন। মাঝে মাঝে ভিক্ষা করতেন।

ভাইয়ের স্ত্রী টুংকি বলেন, আমরা নিজেরা ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারি না। তাই তাকে ও তার ছেলের ভরণপোষণ করা কঠিন।

ওই বাড়ির এক প্রান্তে দেখা যায় সোনালীর জরাজীর্ণ কুঁড়েঘর। একদিকে গরু, অন্যপাশে সোনার রান্নার চুলা, খাট, কাঠ ও অন্যান্য গৃহস্থালির জিনিসপত্র।

কেন আপনি আপনার সন্তান বিক্রি করতে চেয়েছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সোনালী অসংলগ্নভাবে বলেন, পৃথিবীতে কোনো শান্তি নেই। গর্ভে থাকা অবস্থায়ও তিনি সন্তানদের যত্ন নেন না। কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছি না। কাজও করতে পারি না। তাই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি একজন দত্তক নেওয়ার জন্য খুঁজছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *