এত উন্নয়ন প্রকল্প, তবু অবহেলিত লেভেলক্রসিং
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও রেল দুর্ঘটনা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়। কিন্তু ট্রেন দুর্ঘটনাও নিয়মিত ঘটছে। এসব দুর্ঘটনার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ লেভেল ক্রসিংয়ে ঘটে। তবে এ অবস্থা পরিবর্তনে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। রেলওয়ের উন্নয়নে ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও ক্রসিংগুলো অবহেলিত থেকেই যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোটা দাগে রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার তিনটি কারণ রয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বা সমন্বয় ছাড়াই রাস্তাগুলো বেআইনিভাবে নির্মিত হওয়ায় বেশিরভাগ লেভেল ক্রসিংই অরক্ষিত। অনেক বৈধ লেভেল ক্রসিংও গেটম্যানের অভাবে অরক্ষিত। আবার রেলওয়ে লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় চালক ও পথচারীরা অনেক সময়ই সচেতনতা দেখান না। এ ছাড়া রেলক্রসিংয়ের গেটম্যানদের গাফিলতি রয়েছে। ফলে থামছে না দুর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া লেভেল ক্রসিংয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে।
অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংয়ে রেলওয়ে গেটম্যান রয়েছে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, দুর্ঘটনার সময় তারা সেখানে কোনো দারোয়ানকে দেখতে পাননি। ফলে পর্যটকবাহী মাইক্রোবাস কোনো সমস্যা ছাড়াই রেললাইনের ওপর পড়ে যায়। তবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ট্রেনটি রেলক্রসিং পার হওয়ার আগেই গেটম্যান বাঁশ ফেলে গেট বন্ধ করে দেন। বাঁশ ঠেলেই মাইক্রোবাসটি রেললাইনের ওপর উঠে যায়। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে।
ওই রেলক্রসিংয়ের অস্থায়ী গেটম্যান সাদ্দাম হোসেনও কাছে একই দাবি করেন। সরেজমিনে দেখা যায়, ওই রেলক্রসিংয়ে গেট বন্ধ করার জন্য কোনো বাঁশ ছিল না। কিন্তু দুপাশে দুটি লোহার পাইপ। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় দোকানদার নিজাম উদ্দিন বলেন, ট্রেন আসার আগে লোহার পাইপগুলো ফেলা হয়নি।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে সারাদেশে ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ১,৩৬১টি রেলওয়ের অনুমোদন পায়নি। আবার, ১,৪৯৫ বৈধদের মধ্যে ৬৩২ টির কোনো গেটম্যান নেই। রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৫ মে পর্যন্ত ট্রেনে কাটা পড়ে বা ধাক্কা লেগে অন্তত ৩৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জানা গেছে, ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত গত ৭ বছরে শুধু লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহনের মধ্যে ১৩২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ১৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত তিন বছরে বিভিন্ন ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্তত হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। বৈধ-অবৈধ, ৮৪ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নেই। আবার অনেক সময় গেটম্যান থাকলেও তাদের গাফিলতির কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা।
দেখা গেছে, নিরাপত্তাহীন ক্রসিংগুলো মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে কিন্তু সেগুলোকে নিরাপদ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে রেলওয়ে জনবল সংকট ও মানুষের অজ্ঞতা থেকে রেহাই পায়। বিশেষ করে, ক্রসিংগুলিতে যেখানে কোনও গেটম্যান নেই, রেলওয়ে একটি ছোট সতর্কতা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দায় এড়ায়। দুর্ঘটনার পর তড়িঘড়ি করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট দারোয়ানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এখানেই শেষ এটা পেতে ওখানে যাও. তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না।
রেলের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন যে বিপুল সংখ্যক রেল ক্রসিং অরক্ষিত। রেলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা রোধে আমাদের সামনে দুটি পথ রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো অবৈধ ও অনিরাপদ পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ করা। আরেকটি হলো সব ক্রসিংয়ে গেটম্যান নিয়োগ করা। তবে বর্তমানে ঘটছে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ রেলক্রসিংগুলোতে গেটম্যান নিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে কম গুরুত্বপূর্ণ রেলক্রসিং বন্ধ করতে হবে। তবে তার দ্বিতীয় সূত্রটি বাস্তবসম্মত কিনা সন্দেহ রয়েছে।
জানা যায়, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের খুলশী থানার ঝাউতলা এলাকায় ডেমু ট্রেন ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যসহ তিনজন মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। ওই ক্রসিংয়ে একজন দারোয়ান ছিলেন। কিন্তু ট্রেন আসার সময় তা খোলা ছিল। একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা রেলস্টেশন এলাকায় একটি ট্রেন একটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং দুই বরযাত্রীর মৃত্যু হয়।