সুন্দরবন নাশ করে বিনোদনের আয়োজন

0

সুন্দরবন প্রকৃতির এক অনবদ্য দান। প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে উপকূলীয় সুরক্ষা হিসাবে বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাস-প্রশ্বাসের বন সিডার, আইলা, বুলবুল বা অ্যাম্পেনে ঢাল হিসাবে আমাদের রক্ষা করেছে। কিন্তু ভালোবাসার এই বন নিজেই বন বিভাগের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা ও লোভের শিকার। উন্নয়নের নামে ইট-কংক্রিটের ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে।

২০১৭ সালে, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সুন্দরবনে চারটি টহল ফাঁড়ি নির্মাণের প্রস্তাব করেছিল। বন বিভাগ বলেছে যে এখানে ফাঁড়ি স্থাপন করলে প্রচুর সংখ্যক গাছ কেটে ফেলা হবে, যা জীববৈচিত্র্য এবং বন্যপ্রাণীর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বন বিভাগের এই অকাট্য যুক্তির কারণে র‌্যাবের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়নি। সাড়ে চার বছর পর বনের গাছ কেটে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করছে বন বিভাগ। ইকো-ট্যুরিজমের নামে কংক্রিট বসানো হচ্ছে। এতে বনে পর্যটক ও নৌকার চাপ বাড়বে। স্থায়ী স্থাপনা দীর্ঘমেয়াদে বন্যপ্রাণী ও বনের পরিবেশের ক্ষতি করবে। তাই এ পরিকল্পনা থেকে সরে যাওয়ার পরামর্শ বন সংশ্লিষ্টরা।

সুন্দরবনের অভ্যন্তরে করমজল, কটকা, কচিখালী, দুবলারচর, কলাগাছিয়া, হারবাড়িয়া ও নীলকমল নামে সাতটি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। এই সংস্কারের পাশাপাশি, ২০২০ সালে আরও চারটি নতুন পর্যটন গন্তব্য গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে। ‘সুন্দরবনে ইকো-ট্যুরিজম সুবিধার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ওই বছরের ২৬ জুন অনুমোদিত হয়। ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির মাঠপর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে গত বছরের আগস্ট থেকে।

প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের কলাবগী (কৈলাসগঞ্জ) ও শেখের টেক এবং চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক ও শরণখোলা রেঞ্জে আলিবান্দায় ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। হাড়বাড়িয়া, কটকা ও কচিখালীতে সাতটি আরসিসি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থাকবে। দুই মিটার চওড়া ও তিন কিলোমিটার দীর্ঘ পথ, তিন কিলোমিটার আরসিসি সড়ক, আটটি পাবলিক টয়লেট, ৩০টি বেঞ্চ ও ২০টি ডাস্টবিন নির্মাণ করা হবে পর্যটকদের বনে চলার জন্য। এটা সব কংক্রিট. এ ছাড়া করমজলে একটি ঝুলন্ত সেতু, ১৬টি গোলচত্বর, করমজল ও কলাগাছিয়ায় দুটি গেট এবং পর্যটকদের জন্য একটি নৌকা কেনা হবে। পর্যটন কেন্দ্রে কংক্রিটের খাঁচায় হরিণ ও কুমির রাখা হবে।

দাকোপের কলাবগী ইকো-ট্যুরিজম ঘুরে দেখা গেছে, পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করতে খালের ওপারের বনের একাংশ কেটে ফেলা হয়েছে। আরসিসি ওয়াকওয়ে, হরিণ ও কুমিরের শেড, টাওয়ারের কাজও চলছে সমানতালে। গোসলখানা ও গোলাঘরের কাজ প্রায় শেষ। হরিণসহ বেশ কয়েকটি শাবক ও দুটি কুমির আটক করা হয়েছে। শেডের কাজ শেষ হলে এগুলো সরিয়ে ফেলা হবে। মন্দিরের চারপাশে শেখের বেঁচে থাকা পদচারণা। সেখানেও অনেক গাছ কাটা হচ্ছে। একইভাবে কাজ চলছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের আন্ধারমানিক ও আলিবান্দায়।

গাছ কাটার বিষয়ে খুলনা রেঞ্জ কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, কলাবগীতে একটি পদ খালি ছিল। হাঁটার জন্য কেটে ফেলা হয়েছে কয়েকটি গাছ। শখের বেঁচে থাকা গরানা গাছ বেশি। এগুলো ক্রমবর্ধমান নয়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাটতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে: সুন্দরবনের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। তিনি বলেন, ইকো-ট্যুরিজমের নামে যা করা হচ্ছে তা শেষ পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব নয়। এত কিছু জানার পরও অনেকেই বুঝতে পারেন না এমন স্পর্শকাতর জায়গায় কী ধরনের আচরণ করা উচিত। এটা বনের জন্য ক্ষতিকর। তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনের মতো বনাঞ্চলেও উন্মুক্ত পর্যটনের সুযোগ রাখা দরকার। প্রাণীরা পারফিউম এবং প্রসাধনীগুলির গন্ধ অপছন্দ করে যা মানুষ ব্যবহার করে, যা তাদের প্রজননকেও বাধা দেয়।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, বনে কংক্রিট স্থাপন বন ও বন্যপ্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

সুন্দরবনের ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আলম ডেভিড বলেন, পর্যটকরা ইট-পাথরের স্থাপনা নয়, প্রকৃতি দেখতে সুন্দরবনে আসেন। বনের মাটি এবং কাঠের হাঁটার পথ তাদের বেশি আকর্ষণ করে। নতুন ইনস্টলেশন তাদের বিরক্তির কারণ হবে। তিনি বলেন, “সুন্দরবন রক্ষায় আমরা বড় অংশীদার হলেও এসব প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয় না। ফলে জঙ্গলে গড়ে উঠছে চিড়িয়াখানার মতো হাস্যকর স্থাপনা। মানুষ কেন সুন্দরবনে খাঁচায় হরিণ ও কুমির দেখতে যায়? ‘

বন বিভাগের ভাষ্য: প্রকল্প পরিচালক ও খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, প্রতিবছর পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। এতে বনাঞ্চলে চাপ বাড়ছে। এই চাপ কমাতে লোকালয়ের কাছাকাছি চারটি কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। স্থাপনের জন্য আরসিসি করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *