করোনার ভয় শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই!
গত সাত মাস ধরে দেশজুড়ে চলছে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সরকারি-বেসরকারি অফিস সবই খোলা। কলকারখানাও খোলা আছে। বাণিজ্য মেলা হয়ে গেল, বইমেলা শুরু হবে চলতি মাসেই। এভাবে ‘স্বাস্থ্য বিধি’ মেনে প্রায় সবকিছু খোলা রাখা হলেও সারাদেশে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হলে, 1৭ মার্চ সমস্ত ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। টানা ৫৪৪ দিন বর্ধিত ছুটির পরে ১২ সেপ্টেম্বর এটি পুনরায় খুলে দেওয়া হয়। দেড় বছরের বেশি সময় পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হলেও একই সঙ্গে সব শ্রেণির ক্লাস শুরু করা যায়নি। এরই মধ্যে ২১ জানুয়ারি আবারও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
প্রাথমিকভাবে দুই সপ্তাহ বন্ধ। যেহেতু সংক্রমণ এখনও বাড়ছে, তাই ৬ ফেব্রুয়ারির পর ছুটি আরও বাড়ানো হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া ভালো সমাধান নয়। তারা প্রশ্ন তোলেন, সব খোলা, শুধু স্কুল বন্ধ কেন?
শিক্ষাবিদদের মতে, করোনা ইতিমধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। ২০২০ সালের এইচএসসি, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছিল। এইচএসসি শিক্ষার্থীদের ‘অটোপাস’ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সিলেবাস কমিয়ে মাত্র তিনটি বিষয়ে নেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। কোভিড সংক্রমণের কারণে এবারের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সিলেবাসও ছোট করা হয়েছে। এগুলো শিক্ষার জন্য ‘বজ্রপাত’।
এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টানা ছুটি থাকায় বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাও জটিল হয়ে পড়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বেকারত্বের দিন দীর্ঘ হচ্ছে।
চলমান করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বের অনেক দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের অন্তত ৯৫টি দেশে কিছু বিধিনিষেধ সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। ২৬টি দেশে কোনো বিধিনিষেধ ছাড়াই স্কুল খোলা আছে।
নটরডেম কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সমুদ্র দে গোমেজ বলেন, বাণিজ্য মেলা, বিভিন্ন সরকারি সম্মেলন, বিশাল শপিংমল, গণপরিবহন সবই চলছে এবং শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা যাচ্ছে না।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড.শাহান আরা বেগম বলেন, শিক্ষার্থীদের কথা একবার ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন। শারীরিক ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে, যদিও সীমিত পরিসরে, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি নিয়ম মেনে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়াই একমাত্র সমাধান হতে পারে না।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শাহমিকা শাহরিন অনামিকা বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আদেশ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় জমায়েত ও অনুষ্ঠান করতে পারবে না শতাধিক মানুষ। যারা এসব ক্ষেত্রে যোগ দেবেন তাদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট আনতে হবে। অন্য ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সুযোগ থাকলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কেন বৈধ হবে না?
তিনি বলেন, “প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বাদ দিলে তারা ছোট, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা কি ঘরে বসে আছে?” থাকতে পারবে না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোমেনুর রসুল বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সমস্যা শুধু একাডেমিক ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই সমস্যার গভীরতা চার-মাত্রিক। অনেক বিষয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল থাকলে কোটি কোটি মানুষের আয়ের পথ সক্রিয় হয়। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের পরিশ্রমের হাত চলে যায় মাথায়। চিন্তা, হতাশা গ্রাস করে শত শত পরিবারকে।