সৌদিতে রোহিঙ্গারা হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সৌদি আরবে অবস্থানরত ৬৯ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে আট হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হল যে আবেদনকারীরা কেবল নিজের জন্য নয়, তাদের স্ত্রী, সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের জন্যও আবেদন করছেন। ফলে ৬৯ হাজার আবেদনকারীর বিপরীতে প্রকৃত সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এমতাবস্থায় সৌদি আরবের বাংলাদেশ মিশন এসব আবেদনকারীদের পাসপোর্ট দেওয়া হবে কি না সে বিষয়ে মতামত চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।
জানা গেছে, এসব রোহিঙ্গারা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক না হলেও তাদের বাংলাদেশিদের মতোই পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে এসব রোহিঙ্গা ও প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিকদের আলাদাভাবে শনাক্ত করার সুযোগ থাকবে না।
রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত হাসিনা সরকার নিয়েছে বলে স্পষ্ট করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তৌহিদ হোসেনও। তিনি আমাদের বলেছেন, আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।
আগের সরকার এসব রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়া শুরু করে।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দায় অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এটি এই পাসপোর্ট প্রদান কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা, যা পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ ‘গোপন’ রাখে। সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছে, যার মধ্যে স্ত্রী, সন্তান, নাতি-নাতনিদের সংখ্যাই বেশি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। মিয়ানমারের অনেক মুসলিম নাগরিকও (রোহিঙ্গা) সেখানে নানা কাজে নিয়োজিত। তারা পাসপোর্ট ছাড়াই বিশেষ কার্ড নিয়ে দেশে কাজ করছেন। তাদের অনেকেই ভুয়া নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও ভিসা নিয়ে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। এ সংখ্যাও কম নয়। কিছু মানুষ মেয়াদ শেষে জাল পাসপোর্ট নবায়ন করতে না পেরে সৌদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এ ছাড়া এসব বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গেও জড়িত, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনামকে আরও ক্ষুণ্ন করছে। তবে সৌদি সরকার বরাবরই জাল পাসপোর্টধারী এসব রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহ খালিদ বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ মানবিক কারণে ৬৯ হাজার রোহিঙ্গাকে তার দেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এরপর থেকে সৌদি সরকার এসব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে সৌদি সরকার ৬৯ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। সৌদি সরকারও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না আনলে ওই দেশে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকদের ফেরত পাঠানোর হুমকি দিয়ে ২০২০ সালের জুলাই মাসে একটি কূটনৈতিক চিঠি (নোট মৌখিক) পাঠিয়েছিল। এরপর বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়। একই সঙ্গে এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়। তা সত্ত্বেও সৌদি সরকারের চাপ অব্যাহত ছিল।
জানা যায়, সৌদি আরবে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের অনেকেই পরবর্তীতে বিভিন্ন কৌশলে সৌদি আরবের বাংলাদেশ মিশন থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পান। ওই পাসপোর্ট নিয়ে তারা বাংলাদেশেও যাতায়াত করেন। সৌদি সরকার বাংলাদেশকে এ ধরনের অনেক নথি দিয়েছে। রোহিঙ্গারা কীভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেল সে বিষয়ে এখনো কোনো তদন্ত হয়নি