জননেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী স্মরণে: হেলাল উদ্দিন চৌধুরী (তুফান)

0

আজ ১ জুলাই জননেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই ঢাকার পিজি হাসপাতালে বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হসপিটালে ৬৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীসভার স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকীতে সন্তান হিসাবে তাঁর সাধারণ জীবনযাত্রার উপর নতুন প্রজন্মের জন্য কিছু লিখার চেষ্টা করছি।

আমার পিতা মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য রাজনীতি শুরু করেন। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার কলকাতায় খিদিরপুর ডক শ্রমিক প্রতিষ্ঠাতার মাধ্যমে শ্রম রাজনীতির সাথে জড়িত হন। সারাজীবন শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন। অতি সাধারণ জীবনযাপন করে, দীর্ঘ ৪২ বছর আমৃত্যু সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।

১৯৬০ এর দশকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রাজনৈতিক কর্মসূচি, সভা, সমাবেশ ও সম্মেলন উপলক্ষে অনেকবার চট্টগ্রাম শহরে আগমন করেছেন। ৬০ এর দশকে যখন সারা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একক নেতৃত্বে ৬ দফা, ১১ দফা, ও ৭০ এর নির্বাচন নিয়ে উত্তাল সেই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে বারবার চট্টগ্রাম সফর করেছেন। তখন চট্টগ্রাম আগমনের পর তিনি তৎকালীন ডাকবাংলা বর্তমান মোটেল সৈকত হোটেলে আমার বাবা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরীর ২৩ নং রুম ও হল ঘরে, চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাথে সভা করে ডাকবাংলার সামনে স্টেশন সড়কে মিসকা হোটেলে অবস্থান করতেন এবং সন্ধ্যায় আবদুল মাবুদ সওদাগরের হোটেল শাহজানের ৭০৩ নং রুমে রাত্রিযাপন করতেন। তিনি হোটেল শাহজানকে খুব পছন্দ করতেন। সেই সময় হোটেল আগ্রাবাদের মালিক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আগ্রাবাদ হোটেলের রুমে থাকার জন্য অনুরোধ করলে, তিনি অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে সাধারণ হোটেল শাহজাহান ও মিসকা হোটেলে থাকতেন। তিনি কখনো বিলাসী জীবনযাত্রা পছন্দ করতেন না এবং সাধারণ বাঙালির মত জীবনযাপন করতেন, বঙ্গবন্ধুর সকল রাজনৈতিক সহকর্মী ও সহযোগীও সাধারণ জীবনযাপন করতেন।

৬০ এর দশকে স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল রাজনৈতিক অবস্থায় ৭ কোটি মানুষ এক দফার স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে কোটি টাকা পোস্টার, ফেস্টুন ছিলো না, ছিলো না ব্যয়বহুল রঙিন পোস্টার ও তোরণ লাগানোর অনৈতিক প্রতিযোগিতা। আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীগণ সাদা পোস্টার কাগজে হাতের লিখা ও দেওয়ালে সাদাকালো চিকা দিয়ে লিখেছেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নেতৃত্বে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ।

৬০ এর দশকে চট্টগ্রাম শহরের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল, আমাদের দামপাড়া পল্টন সড়কের ৩৭ নং দামপাড়া বাড়িটি,যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমার পিতা মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরীর নিকট প্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদের বাসার ৮০৭০৮৫ নং টেলিফোনে স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রেরণ করেন। সেই বাড়িতে শহরের ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মীরা নিজ হাতে সাদা কাগজে পোস্টার লিখে রাত জেগে দেওয়ালে দেওয়ালে লাগাতেন এবং রাত জেগে শহরের দেওয়ালে চিকা লিখতেন। অভাব ও দরিদ্রতার কারণে পোস্টারের সাদা কাগজ ও লিখার কালি কিনার টাকা ছিলো না। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীগণ নিজ পরিবার থেকে টাকা যোগাড় করে আওয়ামী লীগের প্রচার প্রচারণার জন্য নেতাকর্মিরা সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতেন। নিজের ছবি বা ভাড়া করা নেতার ছবি দিয়ে পোস্টার ফেস্টুন লাগানোর অনৈতিক প্রতিযোগিতা ছিলো না। সততা, যোগ্যতা, ত্যাগ ও আদর্শের আবদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা ৬ দফা, ১১ দফা, নির্বাচন ও স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরিচালিত হয়ে এই দেশকে পাকিস্তান থেকে মুক্তি করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। আজ এই দিনে আমি শ্রদ্ধার সাথে ৬০ এর দশকের সেই নেতা ও কর্মীদের স্মরণ করি।

আজ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ন্যায়, নীতি, প্রজ্ঞা, আদর্শ, ত্যাগ, সততা, যোগ্যতা, এমন এক অনৈতিক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যেখান থেকে ফিরে উঠে আসা অনেক কঠিন। এখন আর দেশপ্রেম ও আদর্শের জন্য রাজনীতি নেই। পদ-পদবি, অর্থ-বাণিজ্য এখন রাজনীতির মূলমন্ত্র। ৬০ এর দশকের সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার সহযোগী রাজনীতিবিদদের আদর্শের রাজনীতি এখন অনুপস্থিত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন রাজনৈতিক সহকর্মীদের নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই, কয়েকজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ বেঁচে আছেন। অন্যরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

আজকের রাজনৈতিক নেতাদের জীবনযাপনের চিত্র দেখে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কীভাবে একজন রাজনৈতিক নেতা বিলাসী জীবনযাপন করেন। দামি গাড়ি, উচ্চবিলাসী সামগ্রী ব্যবহার করেন। ব্যাংকের জমানো টাকা বা সম্পদের কথা নাই বা বললাম। আমার বাবার সময়ের রাজনীতিবিদ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে সকল রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনে দীর্ঘ সময় ত্যাগ ও তিতিক্ষা করে, আমাদের স্বাধীনতা উপহার দিয়ে গেছেন, একটি মানচিত্র, একটি পতাকা একটি জাতীয় সঙ্গীত। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সে সকল রাজনীতিবিদদের, যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে এই সংগ্রামে আমৃত্যু লড়েছেন।

এম এ আজিজ, মনসুর আলী, তাজুদ্দিন আহম্মদ, কামারুজ্জামান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ফনী ভূষণ মজুমদার, শেখ সেরনিয়াবাত, সোহরাব হোসেন, আব্দুল মালেক উকিল, শেখ আবদুল আজিজ, ইউসুফ আলী, আবদুস সামাদ আজাদ, এই সকল ত্যাগী পুরুষ আমার বাবার সাথে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রীসভায় একই সাথে দীর্ঘ সময় একসাথে এই দেশের স্বাধীনতার জন্য বাংলার দুঃখী মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেছেন। কিন্তু গৌরবের সাথে বলতে পারি এসকল বিখ্যাত নেতাদের পরিবার এখনো জীবনযুদ্ধে ঠিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এদের কেউই এত ক্ষমতাবান থাকার পরও পরিবারের জন্য কিছুই রেখে যাননি।

১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার জন্য ঢাকায় আওয়ামী লীগের সভা ডাকেন বঙ্গবন্ধু। উক্ত সভায় বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা নিয়ে শীর্ষ নেতারা বিরোধিতা করলে এম.এ. আজিজ চাচা এবং আমার বাবা ৬ দফার পক্ষ নিয়ে ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আমার বাবা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১১:৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আমাদের দামপাড়া বাসায় ৮০৭৮৫ টেলিফোন এ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠানোর জন্য ফোন করেন। তখন আমার বাবা জহুর আহম্মদ চৌধুরী চট্টেশ্বরী সড়কের মেডিকেল হোস্টেল এর বিপরীতে পাহাড়ের উপর ওয়াপদা রেস্ট হাউজে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের সাথে অবস্থান করছিলেন। আমার মা টেলিফোন কলটি গ্রহণ করেন এবং বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ডিকটেশন দেন এবং আমার মা ডাঃ নুরুন নাহার জহুর নিজের হাতে লিখে নেন এবং তাৎক্ষণিক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রেরিত স্বাধীনতা ঘোষণাটি কয়েক কপি লিখে নেন। এক কপি আমার বাবার নিকট প্রেরণ করেন। চট্টগ্রাম শহরে প্রচারের জন্য তিনি আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতাকর্মীদের প্রেরণ করেন।

পরবর্তীতে এমএ মন্নান, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোসলেমউদ্দিন আহমেদ, ইদ্রিস আলম, হারিস, বদন দিদারী, বদিউল আলম, নুর মোহাম্মদ, মোস্তাসিম বিল্ল্যাহ, শফরআলী ইলিয়াস চৌধুরী ভোর রাত্র থেকে চট্টগ্রাম শহরে মাইক দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী প্রচার করেন এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শহরের অলি গলিতে স্বাধীনতা ঘোষণাটি দুপুর পর্যন্ত প্রচার করে। এই কাজের নেপথ্যে সবচেয়ে বেশি যার ভূমিকা ও পরিচয় না দিলে অকৃতজ্ঞতা হবে, তার নাম নুরুল হক, তিনি চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের পিয়ন। নুরুল হক আমার বাবা জহুর আহমেদ চৌধুরীর যাবতীয় কাজ করতেন। তিনি আমার মায়ের নিকট থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীটি সংগ্রহ করেন। প্রথমে আমার বাবাকে পৌঁছান। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম শহরের নেতাকর্মীদের বিলি করেন। এমনকি তিনি সাইক্লোস্টাইল মেশিনে কপি করে সারা শহরের নেতা ও কর্মীদের বিতরণ করেন। “নুরুল হক”-এর অবদান ও ইতিহাস চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। নুরুল হকের নাম ছাড়া চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের ইতিহাস লিখা কখনো পরিপূর্ণ হবে না।

আমি আজকের এদিনে নুরুল হক-কে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। মহান আল্লাহ যেন তাকে বেহস্ত নসীব করেন। একটা কথা না বললে নয়। আজ অনেক নব্য আওয়ামী লীগের নেতা আছে, যারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রকৃত ইতিহাস জানে না। তারা এমনকি নুরুল হকের নাম বললে চিনবে না। নুরুল হক চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের পিয়নের দায়িত্ব পান ১৯৬৫ সালের পর। ৬ দফা, ১১ দফা, ৬৯ এর গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান আমি আমার কৈশোরের ১১ বছর বয়সে নিজ চোখে দেখেছি এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি এবং আমার ছোট ভাই প্রয়াত কামরুদ্দিন চৌধুরীকে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে মিরসরাই দিয়ে ভারতের বর্ডার পার করে, আমার বাবার নিকট পৌঁছিয়ে ছিলেন নুরুল হক।

আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং আমার পরিবার সারা জীবন নুরুল হকের নিকট কৃতজ্ঞ থাকবো। আজকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সুখের দিনে নুরুল হকদের কেউ স্মরণ করেন না। স্মরণ করেন না সোলতান আহম্মদ কনটেকটরকে, ইউসুফ মিয়া (বুলবুল ইউসুফ) নিজাম সাহেব (আজিজ উদ্দিন লিঃ) বদন দিদারী, নুর মোহাম্মদ, ইদ্রিস আলম, বদি চাচা, অমল মিত্র, শফিকুল বশর, কামাল (চিমুক), হারিস চাচা, মানিক চৌধুরী, এন জি কামাল (বোম কামাল), সালেহ জহুর কনটেকটর, সালেহ আহম্মদ (চকবাজার), আরও অনেক অগণিত নাম যাদের ত্যাগ ও সংগ্রামের সফল আজকের বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এসকল নেতা ও কর্মীদের।

আমার মরহুম পিতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচয় কোলকাতায় ১৯৪৩ সালে। বঙ্গবন্ধু তখন কোলকাতা ইসলামী কলেজের ছাত্র। বঙ্গবন্ধু সেই সময় মাত্র ২৩ বছর বয়সের টকবগে যুবক। আমার পিতা ১৯৩৮ সাল থেকে মুসলিম লীগ ও খিদিরপুর ডক শ্রমিক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি থাকার কারণে কোলকাতায় অবস্থান করতেন। শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দিও ঘনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে আমার পিতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর সাথে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় করিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আমার পিতার বয়সে ছয় বছরের কনিষ্ঠ। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে তখন আমার পিতা এবং জননেতা এম.এ. আজিজ সমান তালে চট্টগ্রামের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করেন।

বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার পিতার পরিচয়ের থেকে আমার পিতা মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরী মৃত্যু পর্যন্ত আমরণ রাজনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধু আমার পিতাকে খুব ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধুর দু:সময়ে এবং প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমার বাবার সাথে সমস্যা সমাধানের জন্য সব সময় আলাপ আলোচনা করতেন। আমার পিতা আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে একদিনের জন্য দূরে সরে যান নাই। আমার বাবা এবং আমার পরিবারের সাথে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে এখনো সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা এখনো সেই পুরাতন ঐতিহাসিক সম্পর্কের বন্ধন ধরে রেখেছি। ছেলে হিসেবে আমার বাবার মৃত্যুর আগে ও মৃত্যুর পরের বঙ্গবন্ধুর অনেক স্মৃতি মনে আছে।

আমি সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছি ১৯৬৬ সালে যখন আমার বয়স ছয় বছর। ১৯৬৬ সালে লালদীঘি মাঠে ৬ দফা ঘোষণার মিটিং উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম আসলে আমাদের ৩৭নং দামপাড়া বাসায় রাতের খাওয়া খেতে আসেন। আমার যতদুর মনে পড়ে আমার মা মরহুমা ডাঃ নুরুন নাহার জহুর সারাদিন বিভিন্ন প্রকার খাওয়া রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন। রাতে যখন বঙ্গবন্ধু আমার বাবা এবং অন্যান্য নেতাদের নিয়ে আমাদের বাসায় আসেন আমিসহ আমার ভাই ও বোনেরা সবাই তখন ঘুমে। আমরা মা বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য ঘুম থেকে আমাদের টেনে তুলেন এবং বঙ্গবন্ধু আমাদের সব ভাই বোনদের জড়িয়ে ধরে আদর করেন। এ প্রথম দেখা।

১৯৭৪ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখ আমার পিতা লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন (বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল, শাহবাগ)। সে সময় বাজেট ঘোষণা অধিবেশন চলছিল। বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন সন্ধ্যায় পিজি হাসপাতালে আমার বাবাকে দেখতে চলে আসতেন এবং দুই থেকে তিন ঘন্টা সময় ওখানে অবস্থান করতেন এবং আমার বাবার মৃত্যুর আগের দিন ৩০ জুন ১৯৭৪ সালে সন্ধ্যার পর আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেছেন। তার আগে ডাঃ নুরুল ইসলাম সাহেব বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, উনার বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সেই রাতে আমার বাবার সাথে বঙ্গবন্ধুর শেষ দেখা ও বিদায়। ১ জুলাই ১৯৭৪ সালে ভোর ছয়টায় আমার বাবা মৃত্যুবরণ করেন।

আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু আমাদের ৩৪ নং মিন্টু রোড বাসভবনে ছুটে আসেন এবং মন্ত্রীপরিষদ সদস্য, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল স্তরে আমার বাবার শেষ বিদায় ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশসহ নিজ দায়িত্বে নিজের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে গোসল দেওয়া, কাফন পরানো, খতম কোরআন, এবং ঢাকায় দুইটি জানাজা নামাজ একটি আওয়ামী লীগ অফিসে অন্যটি জাতীয় সংসদ ভবনে (বর্তমানে প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়) জানাজার নামাজের ব্যবস্থা করেন। সর্বস্তরের মানুষের ফুলেল শ্রদ্ধা এবং প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভা ও আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধু নিজে শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করেন এবং দুইটি জানাজা সম্পূর্ণ করার পর বঙ্গবন্ধু আমার বিশাল পরিবারের সদস্যসহ, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়ে একটি বিশেষ বিমানে চট্টগ্রামে আসার ব্যবস্থা করেন এবং হেলিকাপ্টারে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম আগমন করেন। চট্টগ্রামের প্যারেড গ্রাউন্ডে জানাজার পর বঙ্গবন্ধু নিজে উপস্থিত থেকে দামপাড়া আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতি, তিন বাহিনীর প্রধানসহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমার পিতা মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরীর দাফন কার্য সম্পন্ন করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার বাবাকে তিন বাহিনীর গান স্যালুটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে দাফন কার্য সম্পন্ন করেন। আমার পিতাকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে শেষ বিদায় জানান।

আমার পিতার দাফনের পর আমাদের দামপাড়া বাসায় আমাদের পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে বসেন এবং বলেন, জহুরের অবর্তমানে এই পরিবারের দায়িত্ব আজ থেকে আমার। সেই অনুযায়ী মহান নেতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের বিশাল পরিবারের দেখাশোনা করে গেছেন।

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আমার মা ডাক্তার নুরুন নাহার জহুর আমাদের সব ভাই বোনদের নিয়ে বসলেন এবং বললেন আমরা যত দ্রুত সম্ভব এ বাড়ি ছেড়ে দামপাড়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাড়ি মেরামত করে ওখানে চলে যাব। এবং অশ্রু চোখে বললেন যে দেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে সে দেশে কিছুই বিশ্বাস করার নেই। বিশ্বাসঘাতক মোনাফেকরা এ বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করবে। বঙ্গবন্ধু নেই, তোমরা আবার দ্বিতীয় বারের মতো এতিম হলে। তোমরা বাবা মৃত্যুর পর একবার, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার এতিম হলে। আমরা নাসরিাবাদ হাউজিং সোসাইটির বাড়িটি ছেড়ে দামপাড়া পাকস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক ধ্বংসকৃত বাড়িটি মেরামত করে ৩৭ দামপাড়ায় বসবাস শুরু করি এবং ৭৫ পরর্বতীতে আমাদের জীবন অনেক কষ্টের চলে, যা এখানে লিখে শেষ করা যাবে না। পড়ালখো করার খরচ ছিল না। সপ্তাহে ৭ দিন দুই বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা হতো না। দিনের পর দিন রাতে না খেয়ে আমরা ঘুমাতাম, স্কুলের বেতন, মাস্টারের বতেন, টিফিন, স্কুল ড্রেসের কিছুই ঠিকমত বা স্বাভাবিক নিয়মে ছিল না, অভাব অনটনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ আর যুদ্ধ।

এরপর সরকারী নির্যাতন হয়রানি তো ছিলই। আমরা আস্তে আস্তে এ অভাব মোকাবেলা করতে শুরু করলাম। আমরা মা ডাক্তারি করে রোগী দেখে কিছু আয় করতে শুরু করলেন। আমরা নানার বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে আস্তে আস্তে আমাদের জীবন স্বাভাবিক হতে থাকে এবং আমরা এত অভাব, অনটন ও সরকারি নির্যাতন, হয়রানি মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ৭৫ পরর্বতী সংগঠিত করার জন্য আমাদের পরিবারের সব ভাই-বোন এক সাথে কাজ শুরু করলাম। সে সময় আমরা বড় ভাই মাহতাম উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মরহুম এম.এ. মান্নান সাহেব সভাপতি ছিলেন।

১ জুলাই ১৯৭৪ সালে আমার পিতার মৃত্যুর ১০ দিন পর বঙ্গবন্ধু আমার মাকে দেখে নিয়ে আমার বড় বোন জেরিনা শিরিনের বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নেন। ১৯৭৪ সালে আগস্ট মাসে আমাদের ঢাকার বাসা ৩৪ মিন্টু রোডে বঙ্গবন্ধু আমার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানের যাবতীয় ব্যবস্থা নিজ উদ্যোগে গ্রহণ করেন। খাওয়ার মেনু থেকে শুরু করে বিবাহের যাবতীয় খরচ দিয়ে। নিজে উপস্থিত থেকে মন্ত্রীসভা, প্রশাসন, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিজে উপস্থিত থেকে হলুদ অনুষ্ঠান থেকে বিবাহ অনুষ্ঠান পর্যন্ত সকল অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে বিবাহ অনুষ্ঠানের কাজ সম্পন্ন করেন। জামাতা এম.এ. আহাদ বঙ্গবন্ধুর একজন ঘনিষ্ঠ কর্মী ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন, মুজিবনগর সরকারের সাথে কাজ করেন এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আমার বোনকে নিয়ে কানাডার উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করেন।

আমার বাবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ১৯৭৩ সালে বিদেশ থেকে এক বিশাল পরিমাণের খেলার সামগ্রী আসে সুইডেন থেকে। প্রচুর ফুটবল আসে। শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমার মাকে ফোন করে খবর দিলেন চাচি আমি আসবো আমার জন্য ২০টি ফুটবল দিতে হবে। আপনি ব্যবস্থা করবেন। তখন আমার প্রয়াত ভাই তৌফিক উদ্দিন, শেখ কামাল ভাই এবং শ্রদ্ধেয়া শেখ রেহেনা আপার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মেধাবী ছাত্র তপু ভাই খুব ভালো ক্রিকেট খেলতেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। বিকেলে প্রয়াত শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমার বাসায় আসলেন নিজে একটি জিপ গাড়ি চালিয়ে। উনি বাসায় এসে আমার মায়ের নিকট উপর তলায় গেলেন। আম্মা আগে থেকে শেখ কামাল ভাইয়ের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

শেখ কামাল ভাই বললেন চাচি আমার তাড়া আছে আগে ফুটবল গুলো দেন। তখন মা সাদা কালো ফুটবল গুলো উনাকে দিলেন এবং বললেন আগে খাওয়া দাওয়া করো তারপর যাবে। তখন আমরা মিন্টু রোডে মন্ত্রী বাড়ির আঙ্গিনায় খেলায় ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ দেখি শেখ কামাল ভাই চিৎকার করে বলতে লাগলেন আমার গাড়ি কই। কে নিয়ে গেছে, একটু অপেক্ষার পর দেখলাম তপু ভাই না বলে শেখ কামাল ভাইয়ের গাড়ি নিয়ে চক্কর দিয়ে আসছে। শেখ কামাল ভাই রাগান্বিত হয়ে তপু ভাইকে বলে গাড়ি কেন ধরলেন জিজ্ঞাসা করলো। তপু ভাই একটু পাগলা স্বভাবের ছিল। উনি উল্টা ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলেন। আমরা সবাই খেলা ফেলে দৌড়ে তপু ভাইয়ের কাণ্ড দেখে হাসতে লাগলাম এবং কামাল ভাই তপু ভাইকে পাগলামি ছাড়তে উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন। তপু ভাই এবং শেখ কামাল ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ক্লাসে পড়তেন, ভালো বন্ধুও ছিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট টিমে তপু ভাই ও শেখ কামাল ভাই নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন।

আমার প্রয়াত তৌফিক ভাই আমার বাবাকে অনুরোধ করলেন উনি উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন যাবেন। বাবা বললেন তোমার মত পাগলের লন্ডন যাওয়ার প্রয়োজন নাই এবং আমার কাছে তোমাকে লন্ডন পাঠানোর মতো টাকা পয়সা নাই। তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর নিকট গেলেন এবং বাবার বিরুদ্ধে নালিশ দিলেন যে, উনাকে লন্ডন পাঠানোর অপারগতার কথা এবং বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আমি লন্ডন যাব। বঙ্গবন্ধু জবাবে বললেন, তুই পাগল লন্ডন গিয়ে কি করবি। দেশে উচ্চশিক্ষা নাও। তপু ভাই নাছোড়বান্দা উনি কিছুতেই মানবেন না। বঙ্গবন্ধু তখন পাসপোর্ট এর কথা জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু তপু ভাইয়ের পাসপোর্ট নেই, তখন বঙ্গবন্ধু পাসপোর্ট, টিকেট এবং এক বছরের পড়ার খরচ, ভিসার ব্যবস্থা করে তপু ভাইকে লন্ডন যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। পরে আমার বাবা জানার পর রেগে গেলেন।

১৯৭৪ এর জুলাই মাসে আমার বাবার মৃত্যুর পর আমার বোনের বিবাহ কার্য সম্পন্ন হওয়ার পর আমার মা ডাক্তার নুরুন নাহার জহুর চট্টগ্রামে চলে এসে বসবাসের পরিকল্পনা নিলে বঙ্গবন্ধু আমার মাকে বর্তমান গণভবনে ডেকে নিয়ে যান। ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে আমার মা আমাকে সাথে নিয়ে গণভবনে গেলে জনাব তোফায়েল আহম্মদ সাহেব আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে উপর তলায় বসার ঘরে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই সেখানে বসা ছিলেন। তিনি অশ্রুচোখে মাকে বলেন, জহুর তো কিছুই রেখে যান নাই। তুমি চট্টগ্রাম চলে যাও, ঢাকা বসবাস করা তোমার পরিবারের জন্য অনেক কঠিন হবে। উনি বললেন আমি ইতিমধ্যে তোমার নামে একটি আবেদনপত্র দিয়ে চট্টগ্রামের হাউজিং সোসাইটিতে একটি বাড়ি বরাদ্দ করে দিয়েছি এবং পুলিশ প্রহরা গাড়ি ও টেলিফোন সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি এবং প্রতি মাসে তোমার সংসার খরচের জন্য ৩ হাজার টাকা করে পাঠিয়ে দিব এবং যখন কিছু প্রয়োজন হবে আমাকে সরাসরি ফোন দিও।

বঙ্গবন্ধু বাড়ি বা থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছাড়াও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসার জন্য আসবাবপত্রসহ সকল কিছু চট্টগ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসে আমরা চট্টগ্রাম এসে নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি ৩ নং রোডে ২২/বি বাড়িটিতে বসবাস শুরু করি এবং প্রতি মাসে বঙ্গবন্ধু মাকে টেলিফোন করে আমাদের পরিবারের খোঁজখবর নিতেন।

১৯৭২ সালে আমার পিতা মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী মন্ত্রীসভার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রীসভার মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রী হওয়ার কারণে সর্বপ্রথম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে কাজ শুরুর প্রথম দিন আমার মা ডাঃ নুরুন নাহার জহুরকে তাঁর চাকুরি হইতে অব্যাহতি প্রদান করেন। যেহেতু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আমার মায়ের চাকুরিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে সে কথা বিবেচনা করে আমার বাবা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে আমার মা খুবই মর্মাহত হন এবং বাবার সহিত ঝগড়া করেন। আমার বাবা আমার মাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিচালনায় স্ত্রী একই মন্ত্রণালয়ে চাকুরি করলে প্রভাব বিস্তার করার ও ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ থাকে। তাই তিনি আমার মাকে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অধীনস্থ দপ্তরের চাকুরি হতে অব্যাহতি প্রদান করেন। পরে আমার মা ব্যক্তিগত উদ্যোগে রোগীর সেবা দেওয়া শুরু করেন।

স্বাধীনতা-উত্তর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ পুর্নগঠনে বেশ কিছু উল্লেখ্যযোগ্য পদক্ষেপ নেন আমার বাবা। স্বাধীনতা যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শিশু ও নারী মানবেতর জীবনযাপন করছিল। যুদ্ধে পিতৃমাতৃহারা লক্ষ লক্ষ এতিম ছেলেমেয়েদের এতিমখানায় থাকা-খাওয়া, লেখাপড়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

উল্লেখ্য, উনি চট্টগ্রামের লালখান বাজারের ইস্পাহানি বিল্ডিং, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে তিনটি বাড়ি, মুরাদপুরে বিশাল কয়েকটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং উনি সশরীরে এতিমখানাগুলো পরিদর্শন করতেন। সমাজকল্যাণ দপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক, চট্টগ্রামের মেয়ে জওশন আরা রহমান এই প্রজেক্টগুলো পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত এবং পিতা, স্বামীহারা বিধবা, এতিম, নির্যাতিত নারীদের পুনর্গঠনের জন্য নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। এই প্রকল্পের আওতায় সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় নারী পুনর্বাসন প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন। মহিলাদের সেলাই শিক্ষা, কুটির শিল্প তৈরির শিক্ষা এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র কর্তৃক উৎপাদিত পণ্য বিপণনের ব্যবস্থা নেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় উনি বাংলাদেশে বৃহৎ দুইটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকার বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালটি ছিল তৎকালীন পাকিস্তানিদের শাহবাগ হোটেল। এই শাহবাগ হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে উনি বাসা থেকে যাওয়ার সময় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। শাহবাগ হোটেলকে হাসপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা ও স্বপ্ন দেখেন। চট্টগ্রামের প্রখ্যাত চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম সাহেবকে দায়িত্ব দিয়ে তৎকালীন পিজি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমোদন নিয়ে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করার সে সময় বাংলাদেশের বড় ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি উক্ত শাহবাগ হোটেলটি সরকার থেকে লিজ নিয়ে হোটেল ব্যবসা চালুর চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার পিতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধৃুরী কঠোরভাবে অবস্থান নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহায়তায় হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল নামে পরিচিত।

চট্টগ্রামে ফয়’স লেকস্থ চক্ষু হাসপাতাল তাঁরই অবদান। জার্মান সরকার হতে একটি চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব আসলে তিনি ফয়’স লেকে রেলওয়ে থেকে জমি বরাদ্দ নিয়ে জার্মান সরকারের সহায়তায় বর্তমান চক্ষু হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতিও প্রতিষ্ঠা করেন।

শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম বাংলাদেশে শ্রম আইন সংস্কারের কাজ শুরু করেন, জাতীয় সংসদে শ্রম আইনের সংস্কারে প্রথম বিল উত্থাপন করেন। এতে দেশের শিল্প উন্নয়নের জন্য মালিক শ্রমিক একসাথে কাজ করার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এদেশের শ্রমিক সমাজের স্বার্থ এবং বাংলাদেশের শিল্পে দ্রুত অগ্রগতির লক্ষ্যে উনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।

মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার পর উনি শ্রম দপ্তরে সকল সরকারি কর্মকর্তাদের এক সভা আহ্বান করেন। সভায় এমন একজন উপ-পরিচালক উপস্থিত যিনি পাকিস্তান আমলে আমার পিতার বিরুদ্ধে শ্রম আইনে বিভিন্ন সময় মামলা দিয়েছিলেন। ষাটের দশকে কিছু মামলার কারণে তিনি কারাবরণও করেন। ভদ্রলোক পিছুনের সারিতে বসা ছিলেন। আমার বাবা উনাকে ডেকে সামনের সারিতে বসতে বললেন এবং সভা চলাকালীন উনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি সরকারি কর্মকর্তা। আপনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এখন আপনি বাংলাদেশ সরকারের অধীনে সরকারি কর্মকর্তা। তাই এই সরকারের হুকুম মেনে কাজ করবেন।

তখন ভদ্রলোকের ভয় ও জড়তা কেটে যায় এবং পরবর্তী সময়ে উনি আমার পিতার একজন প্রিয় কর্মকর্তায় পরিণত হন এবং পদোন্নতি লাভ করে সম্মানের সাথে চাকুরি করেন।

আমার পিতা মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী জীবনে কখনো আদর্শ ও দায়িত্বের কাছে পরাজিত হননি। তৎকালীন পিজি হাসপাতাল (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) হাসপাতালে তিনি ১ জুলাই (সোমবার) ১৯৭৪ ভোর ৬টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *