মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণে অসুবিধা
নতুন সিলেবাসে পরীক্ষা ‘না’, মার্কস ‘না’; শিক্ষার্থীরা কিছুই শিখছে না; শিশুরা লেখাপড়া থেকে দূরে চলে যাওয়ার অভিযোগ করছেন অভিভাবকরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এই পাঠ্যক্রমের সমালোচনা করেছেন। জনসভা করতে গিয়ে কয়েকজন অভিভাবককে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ অবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় কারিকুলাম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করে। শিক্ষাবর্ষের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে নানা প্রতিবন্ধকতায় হিমশিম খাচ্ছেন মূল্যায়ন পদ্ধতির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা। অভিভাবকরাও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত দু-একটি বিষয়ের তীব্র সমালোচনা করছেন।
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ৫ জুন সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, কেউ এসএসসিতে দুই বিষয়ে ফেল করলেও এইচএসসিতে ভর্তি হতে পারবে না।
কিন্তু তারা সম্পূর্ণ সার্টিফিকেট পাবে না। তবে মার্কশিট পাবেন। পূর্ণাঙ্গ সার্টিফিকেট পেতে হলে দুটি বিষয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
তার এই বক্তব্যের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় তার সমালোচনা করেছেন অভিভাবকরা। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পেজে তারা নানা মন্তব্য করেছেন। অভিভাবকদের মন্তব্য- কোনো শিক্ষার্থী ফেল করে উচ্চ শ্রেণীতে ওঠার সুযোগ পেলে সে পড়াশোনায় মনোযোগ দেবে না।
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গত ৫ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জাতীয় মনিটরিং ও আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়- নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতি কবে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে? জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রকাশ করা হবে।
জানা যায়, শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্তকরণ সংক্রান্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা এটি আরও মসৃণভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাদের মতামতের পরই নতুন কারিকুলামের মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করা হবে।
এ প্রসঙ্গে কমিটির ওপর নির্ভরশীল সূত্র জানায়, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা তারা লক্ষ্য করেছেন। যেমন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত আদর্শ নয়; পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব; আইটি ক্লাসরুম সুবিধা এবং অডিও ভিজ্যুয়াল সুবিধার অপর্যাপ্ততা; জনসাধারণের মূল্যায়নে বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষকের (অভিজিলেটর) অপ্রতুলতা; সঠিক শিক্ষার পরিবেশের অভাব; অভিভাবক এবং অংশগ্রহণকারী শেখার বিষয়ে ধারণাগত অস্পষ্টতা; মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বিষয়বস্তু ভিত্তিক লিখিত পরীক্ষার অভাব; নৈপুণ্যের অ্যাপ ব্যবহারে শিক্ষকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব; মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনায় শিক্ষকদের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ ইত্যাদি।
জানা গেছে, কমিটি শেখার অভিজ্ঞতা ও কর্মকাণ্ডভিত্তিক মূল্যায়নের ৫০ শতাংশ এবং লিখিত মূল্যায়নের ৫০ শতাংশ রাখার প্রস্তাব করেছে। অর্থাৎ মূল্যায়নের অর্ধেক নম্বরই শিক্ষকদের হাতে।
এ প্রসঙ্গে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক অ্যাডভোকেট অহিদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, পুরো মূল্যায়ন সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকদের কাঁধে থাকলে এর অপব্যবহারের সুযোগও বাড়বে। কোনো শিক্ষার্থীর পছন্দ বা অপছন্দ হলে তা ওই শিক্ষার্থীরই ফল হবে। শিক্ষকরা এমনকি শিক্ষার্থীদের ব্ল্যাকমেইল করে কোচিংয়ে যেতে বাধ্য করবে। কারণ, তার পরীক্ষার হাতে নম্বর রয়েছে। স্কুল শিক্ষকদের প্রাইভেট কোচিং নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। সন্তানের ফলাফল খারাপ হবে এমন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আতঙ্ক রয়েছে অভিভাবকদের মধ্যে।
নতুন মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন বোর্ড চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হওয়া- এতটুকুই বলতে পারি। যেসব ক্ষেত্রে বোর্ডগুলো পরীক্ষা নেয় সেসব ক্ষেত্রে আমরা পরীক্ষকদের দায়িত্ব, পরীক্ষক নিয়োগ এবং কেন্দ্র পর্যবেক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত প্রস্তাবের ওপর আমাদের মতামত দিয়েছি। তিনি বলেন, নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষা ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমাতে হবে। আর সে কারণে অনেক শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। এ কারণে একটি ভালো পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নে কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকবে, যা ধীরে ধীরে মোকাবেলা করতে হবে।
উল্লেখ্য, জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখার আলোকে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠদান শুরু হয়েছে। এ বছর ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।