টানা বৃষ্টিতে বিপযর্স্ত দেশ
শ্রাবণের শুরুতে তাপদাহ ছিল। সাগরে নিম্নচাপ স্বস্তি এনে দিয়েছে গত সপ্তাহে শুরু হওয়া বর্ষায়। নিম্নচাপ চলে যাওয়ায় বর্ষা সক্রিয় হয়ে ওঠে। টানা বর্ষণে শান্তি ফিরে এলেও জনজীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। অবিরাম বর্ষণে বিপর্যস্ত দেশ। রাস্তাঘাট এমনকি ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে গেছে। পানিতে ভাসছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ড্রেনে পড়ে এক ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে।
কক্সবাজারের চকরিয়ায় টানা বৃষ্টিতে ভূমিধসে একই পরিবারের দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কক্সবাজারের বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভূমিধসে মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। বান্দরবানের আলীকদমে পাহাড় ধসে দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া পাবনার ঈশ্বরদীতে পদ্মার তীরে বালির স্তূপে চাপা পড়ে দুই শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। জলাবদ্ধতার কারণে চট্টগ্রাম নগরীর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা তিনদিন বন্ধ রয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। উপকূলের অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।
বান্দরবান থেকে চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি পর্যন্ত সড়ক প্লাবিত হওয়ায় জেলার সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। টানা বৃষ্টিতে উপকূলের অনেক এলাকা এখন বিদ্যুৎবিহীন। কোথাও নেটওয়ার্ক না থাকায় মোবাইল ফোনের যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত। ভোলা, লক্ষ্মীপুরসহ পাঁচটি নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন এলাকার মাছের খাঁচা ও পুকুর ভেসে গেছে। রবিশ্যা ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে তলিয়ে গেছে আমন ধানের ক্ষেত।
কখন থামবে বৃষ্টি?
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হওয়া বৃষ্টি আগামীকাল বুধবার থেকে কিছুটা কমবে এবং শনিবার বাড়বে। আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক জানান, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামের পাশাপাশি সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকার কিছু কিছু জায়গায় ভারী বর্ষণ হতে পারে। ভারী বর্ষণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত ও নদীবন্দরকে ১ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মঙ্গলবারও এই সতর্ক সংকেত অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানান নাজমুল হক।
গতকাল বান্দরবানে দেশের সর্বোচ্চ ৩৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চট্টগ্রামে ১৫৪ মিলিমিটার এবং ঢাকায় ৩৮ মিলিমিটার।
আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ি এলাকা থেকে উপকূলীয় শহরগুলোতে একযোগে এমন ভারী বর্ষণ খুব কমই দেখা গেছে। শেষবার এই ধরনের বর্ষা দেখা গিয়েছিল ১৯৮৫ সালে। ১৯৮৫ সালের ৯ জুলাই শুধু চট্টগ্রাম শহরেই ৩৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। অন্যান্য উপকূলীয় জেলাগুলিতে সেদিন ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছিল। ৩৮ বছর পর গত রোববার চট্টগ্রামে আবারও ৩২২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ১৯৮৩ সালের ৪ আগস্ট চট্টগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল ৫১১ মিলিমিটার। একই বছরের ৫ জুলাই চট্টগ্রামে ৪০৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এরপর ১৯৮৫ সালের ৯ জুলাই ৩৭৪ মিলিমিটার এবং ৮ জুলাই ১৯৮৮ সালে ৩০৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।
রাজধানীতে দুর্ভোগ
টানা দুই দিনের বর্ষণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতায় ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। শনিবার রাত থেকে শুরু হয়ে গতকালও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এ দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে সড়কে পর্যাপ্ত গণপরিবহন না থাকায় দুর্ভোগে পড়েন অফিসগামী মানুষ, স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা। অনেকে বাস, অটোরিকশা বা রিকশার জন্য দীর্ঘক্ষণ সড়কে অপেক্ষা করেন। সড়কে পানি জমে থাকায় বিভিন্ন এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
বাঁধ ভেঙেছে, উপকূল প্লাবিত হয়েছে
ভারি বর্ষণে বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ ভেঙে গেছে। নিচু এলাকা প্লাবিত হয়। মানুষ পানিতে আটকা পড়েছে। ফেনীর ফুলগাজী এলাকায় মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। পানির চাপে বাঁধ ভেঙে ফুলগাজী বাজার, উত্তর বাড়িয়া, বণিকপাড়া, দৌলতপুর, বিজয়পুর, কিসমত বিজয়পুর, বসন্তপুর, জগৎপুরসহ বাঁধের আশপাশের সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আমন বীজতলাসহ অসংখ্য মাছের কলম, গরুর খামার ও মুরগির খামার তলিয়ে গেছে। ১২২ কিলোমিটার বাঁধের বেশ কিছু জায়গা ঝুঁকিতে রয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংলগ্ন এলাকার শতাধিক পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। জেলা প্রশাসক শাহিনা আক্তার ভূমিধসের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং বন্যা দুর্গত মানুষের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেন।
কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও ভূমিধসের কারণে মাতামুহুরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গতকাল কক্সবাজারের পেকুয়ায় পূর্ব মেহরনামার দুটি পয়েন্টে ৮০ মিটার ও ৫০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়। ফলে মাতামুহুরী নদীর পানি ঢুকে পড়েছে মেহেরনামা, সৈকতপাড়া, বলিরপাড়া, মোরাসহ পাঁচটি গ্রামের মানুষ।