পরিদর্শনের পর ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে
বিভিন্ন ব্যাংকের জমাকৃত খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্রের মধ্যে অমিল খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অনেক ব্যাংক গত বছরের শেষে যা দেখিয়েছিল তার চেয়ে বেশি এনপিএল পেয়েছে, যা পরিদর্শনের পর থেকে বেড়েছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে এসব ব্যাংক তাদের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সার্বিক আর্থিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক ব্যাংক আর লভ্যাংশ দিতে পারছে না।
প্রতিটি ব্যাংকের ডিসেম্বরের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান কার্যালয় এবং কয়েকটি শাখা পরিদর্শন করে এবং প্রতিবেদন তৈরি করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে প্রাপ্ত তথ্য, ব্যাংকের নিজস্ব তথ্য এবং বহিরাগত নিরীক্ষকদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়।
বেসরকারি খাতের ২৫টি ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ২০টিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর ব্যাংকের দেওয়া প্রতিবেদনের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন করে পাঁচটি ব্যাংকের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মিল পাওয়া গেছে। ব্যাংকগুলো হলো- ব্র্যাক, দ্য সিটি, প্রাইম, আল-আরাফাহ ইসলামী এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ।
জানা গেছে, ব্যাংকের দেওয়া প্রতিবেদনের সঙ্গে সবচেয়ে বড় পার্থক্য পাওয়া গেছে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত ১০টি ব্যাংকের মধ্যে একটি ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চুক্তি অনুযায়ী- গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। ব্যাংকটি লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছেছে। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া প্রতিবেদনে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ দেখিয়েছে ৬ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তবে পরিদর্শনে নতুন করে ৪ হাজার ১২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের তথ্য উঠে এসেছে। এ হিসাবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তবে প্রকৃত মান বিবেচনা করলে ব্যাংকটির প্রকৃত খেলাপি ঋণ অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে UCBL-এর। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটি ১ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা খেলাপি দেখালেও পরিদর্শন শেষে তা দাঁড়ায় ২ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। ওয়ান ব্যাংক ৯০৪ কোটি টাকা বেড়ে ৩ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা হয়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৭১৫ কোটি টাকা বেড়ে এক হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা হয়েছে। আর সাউথইস্ট ব্যাঙ্ক ৬৭৯ কোটি বেড়ে ২২৫৭ কোটি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিবেদন ভালো করতে অনেক ব্যাংক বিভিন্নভাবে কম খেলাপি ঋণ দেখায়। এটি বিধান রাখার প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে। আবার সেই ঋণের বিপরীতে রিকভারি দেখানো যাবে। তখন মালিক আসল ছবি আড়াল করে ভালো লভ্যাংশ পাওয়ার সুযোগ পায়। আবার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ভালো পারফরম্যান্স দেখানোর জন্য নিয়মিত খারাপ ঋণ দেখায়। এটি ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে হবে। তবে অনেক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল খেলাপি ঋণের তথ্য উদঘাটন করলেও প্রভাব খাটিয়ে তা নিয়মিত দেখানোর ঘটনা ঘটে। ফলে চূড়ান্ত আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলার সুযোগ পান অনেকেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে শ্রেণিকৃত বা খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। যা ছিল মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর তিন মাস আগে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এ হার ছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ১৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা।
আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের চলমান ঋণ কর্মসূচির অন্যতম শর্ত হলো ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমানো। শর্তের আলোকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ২০২৬ সালের মধ্যে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে।