গরমে কৃষিকাজ চরম বিপাকে পড়েছে
বোরো ধান পাকতে শুরু করেছে। মাঠে গড়িয়ে পড়ছে তরমুজ। লিচু, কাঁঠাল, গাছে আম। চিচিঙ্গা, জিঙ্গে, পটোল, টমেটোর মতো গ্রীষ্মকালীন সবজিও মাঠে প্রচুর। দেশে সর্বোচ্চ ফল পাকে এপ্রিল মাসে। ১২ মে থেকে বাজারে যাবে পাকা আম। তবে কৃষি খাতের এই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আগুন ও তাপ কৃষকদের মন দুশ্চিন্তায় ভরিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে ঝলসে যাচ্ছে ফসলি জমি। ঝরে পড়ছে আম ও লিচুর ডাল। বৃষ্টি না হওয়ায় সেচের বাড়তি খরচের কারণে উৎপাদন খরচও বাড়ছে। অন্যদিকে সকালের ঘন কুয়াশা ও দিনের তীব্র গরমের মতো প্রতিকূল আবহাওয়ায় কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
এবার বোরো ভালো ফলন হবে বলে আশা করছেন সবাই। চলতি মৌসুমে ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ টন। হাওয়ারে ইতিমধ্যে ধান কাটা শুরু হয়েছে, তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে আরও কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে। এ সময় দেশে প্রচণ্ড তাপ ও খরার কারণে আশাতীত বোরো ফলন না হওয়ায় শঙ্কিত অনেক কৃষক।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২ এপ্রিল থেকে দেশের কোথাও বৃষ্টি হয়নি। বিপরীতে, টানা ১৭ দিন ধরে দেশের ৯০ শতাংশ এলাকায় তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। খরা অঞ্চলের উপর নির্ভর করে ২০-৫০ শতাংশ অতিরিক্ত সেচের দিকে পরিচালিত করেছে। এতে বোরোর উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কৃষকরা জানান, ক্ষেতে পানি না থাকায় তারা ধান থেকে রেহাই পাচ্ছেন। ধানের শীষ ও পাতা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। অতিরিক্ত টাকা দিয়েও তারা সঠিক পানি পাচ্ছেন না।
রাজশাহীর চারঘাটের বরকতপুর গ্রামের কৃষক কলিম উদ্দিন জানান, গত বছর ডিজেলচালিত নলকূপে সেচ দিতে প্রতি ঘণ্টায় খরচ হয়েছে ১২০ টাকা। এ বছর ডিজেলের দাম বেড়েছে ২০০ টাকা। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা দিয়েও ঠিকমতো পানি পাচ্ছে না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় আগে এক ঘণ্টায় যে পানি পাওয়া যেত এখন তা দুই ঘণ্টায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। উপজেলার কালুহাটি গ্রামের কৃষক আব্দুল মতিন বলেন, প্রচণ্ড খরায় আম নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।গাছের গোড়ায় রস না থাকায় আম শুকিয়ে ঝরে পড়ছে।আনোয়ার হোসেন নামে এক কৃষক। চারঘাটের চৌধুরী বিলের বাসিন্দা বলেন, সারা রাত বরেন্দ্রের গভীর নলকূপ থেকে মাছ চাষের পুকুরে পানি সরবরাহ করা হয়। সকালে আমরা ধান চাষিরা পানি চাইলে অপারেটররা নলকূপ ভাঙাসহ নানা অজুহাত দেয়। ডিজেল চালিত মেশিন দিয়ে চালে পানি দিতে বাধ্য। সারারাত গভীর নলকূপ চলার কারণে শ্যালো মেশিনগুলো দিনে পানি বাড়াতে চায় না।’
রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকরা বলছেন, গত কয়েকদিনের খরায় প্রায় ৩০ শতাংশ আম ও লিচুর শুঁটকি ঝরে গেছে। তবে অফিসিয়াল ড্রপের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এগ্রিকালচার ইনফরমেশন সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা জানান, অপরিপক্ব ফল ঝরে পড়া এবং ফলের আকার কমে যাওয়ার মতো সমস্যার খবর পাওয়া গেছে। পাট ও ভুট্টার উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নওগাঁ বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অঞ্চল-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, জেলায় বিএমডিএর ৪ হাজার ১০৩টি গভীর নলকূপের মধ্যে ৪ হাজার ৮৫টি চালু রয়েছে। তবে নদীতে স্থাপিত প্রায় ৪০০ এলএলপি পানির অভাবে বন্ধের পথে। গতকাল এ মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাবনা সদর ও ঈশ্বরদীতে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। কৃষকরা জানান, অনাবৃষ্টির কারণে প্রতিদিনই গাছ থেকে পাকা আম ও লিচুর ডাল ঝরে পড়ছে। কৃষি বিভাগ জানায়, মাত্র কয়েক বছর ধরে পাবনা ও ঈশ্বরদীতে ৪ থেকে ৫০০ কোটি টাকার লিচু উৎপাদন হয়েছে। এ মৌসুমে আশার সঞ্চার হলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে কৃষকরা চিন্তিত।
এদিকে বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের কাছে লাভজনক ফসল তরমুজ এখন হতাশা। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে কৃষকদের উৎপাদিত তরমুজ প্রতিবছর জেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যায়। কিন্তু এ বছর তীব্র গরমে তরমুজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খরার কারণে বৃষ্টিনির্ভর পাট বাগানে সেচ দিতে হয়। অতিরিক্ত সেচ দিয়েও পাট বাঁচানো যাচ্ছে না। দেশটি কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রত্যক্ষ করে আসছে, বিশেষ করে কৃষি খাতে।