ট্রেনযাত্রায় সন্তুষ্টি জরিপে, উল্টোচিত্র বাস্তবে
মোহনগঞ্জ-ঢাকা রেলওয়ে ‘হাওর এক্সপ্রেস’ সকাল ৮টায় ছেড়ে যায় এবং কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছাবে দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে। তবে গত রোববার ট্রেনটি প্রায় তিন ঘণ্টা দেরিতে আসে। অসন্তুষ্ট যাত্রীদের ক্ষোভ সত্ত্বেও, রেলওয়ের একটি সমীক্ষা দাবি করেছে যে ৫৭ শতাংশ যাত্রী ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা নিয়ে সন্তুষ্ট। অসন্তুষ্ট মাত্র ১৬ শতাংশ যাত্রী।
রেলওয়ের নির্দেশে সংস্থার পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের জন্য চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) এর অফিস দ্বারা জরিপটি পরিচালিত হয়। সেবা নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের শেষ না থাকলেও পূর্বাঞ্চলের জরিপ অনুযায়ী ৬৮ শতাংশ যাত্রী ট্রেনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পশ্চিমাঞ্চলের ৬৬ শতাংশ যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যে ট্রেনে চড়েন। ৭৩ শতাংশ যাত্রী ইস্টার্ন ট্রেনে রেলওয়ে কর্মীদের সেবায় সন্তুষ্ট; পশ্চিমাঞ্চলে এই হার ৫৫ শতাংশ। পূর্বাঞ্চলের ৪৭ শতাংশ যাত্রী এবং পশ্চিমাঞ্চলের ৪০ শতাংশ যাত্রী কখনোই টিকিট পেতে সমস্যায় পড়েননি! মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশ যাত্রীই ট্রেনের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অসন্তুষ্ট। মাত্র ৭ থেকে ৯ শতাংশ যাত্রী ট্রেনের আসন নিয়ে অসন্তুষ্ট।
রোববার কমলাপুরে ১০ যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়। তাদের মতে, রেলের জরিপের ফলাফল প্রায় উল্টো। শুধু অবাস্তবই নয়, জরিপটিও বিভ্রান্তিকর। যত যাত্রীর ওপর জরিপ করা হয়েছে, কিছু প্রশ্নের উত্তরদাতার সংখ্যা তার চেয়ে বেশি!
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাত্রীদের আস্থা রাখতেই জরিপে কারচুপি করা হয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এ ফলাফল বিশ্বাসযোগ্য নয়। ২০১৬ সালে অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। এর ফলে দেখা যায় যে ৮৭ শতাংশ যাত্রী রেল পরিষেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নন।
রেলওয়ের জরিপের ফলাফল বাস্তবসম্মত কিনা তা জানতে বারবার চেষ্টা করেও রেলের মহাপরিচালক কামরুল আহসানের বক্তব্য জানতে পারেনি ।রেলওয়ে সচিব ড. হুমায়ুন কবির বলেন, জরিপ হয়েছে। কিন্তু ইদানীং ট্রেন দেরি হচ্ছে। বিলম্বের কারণ খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।
রেলওয়ে দুটি জোনে বিভক্ত – পূর্ব ও পশ্চিম। রেল নিয়ে যাত্রীরা কী ভাবছেন তা জানতে গত নভেম্বরে জরিপ শুরু হয়। ওই জরিপে পূর্বাঞ্চলীয় ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সুবর্ণ এক্সপ্রেস, ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ রুটে তিস্তা এক্সপ্রেস এবং ঢাকা-সিলেট রুটে পারাবত এক্সপ্রেসের ১ হাজার ৩৬৬ যাত্রীর মতামত নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়। পশ্চিমাঞ্চল অনুযায়ী ঢাকা-খুলনা রুটে সুন্দরবন এক্সপ্রেস, ঢাকা-রাজশাহী রুটে বনলতা এক্সপ্রেস এবং ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের ৩২৭ জন যাত্রীর মতামত নিয়েছেন তারা।
সমীক্ষায় যাত্রীদের ১৪টি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রেলের কর্মচারীরা ট্রেনের যাত্রীদের ফরম ও কলম দেন। প্রশ্নের পাশে ‘হ্যাঁ’, ‘না’ এবং ‘সামান্য/না মন্তব্য’ চারটি অপশন দেওয়া আছে। যাত্রীরা তাতে টিক দিয়েছেন। সেবার উন্নতির বিষয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে মতামত চাওয়া হয়েছে। যাইহোক, সমীক্ষায় ‘অংশগ্রহণকারী’ ১,৬৯৩ জন যাত্রীর কারো কাছ থেকে রেলওয়ে কোনো মতামত পায়নি। পূর্বাঞ্চলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের কাছ থেকে পাওয়া উত্তরের ভিত্তিতে জরিপের গ্রাফ ও ফলাফল তৈরি করা হয়েছে। অবিশ্বাস্য ফলাফলের বিষয়ে তিনি বলেন, নথিপত্র বলতে হবে।
রেলের কর্মীরা এই সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট কিনা? জরিপে অংশগ্রহণকারী পূর্বাঞ্চলের ৯৯৪ বা ৭৩ শতাংশ যাত্রী সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। মাত্র ৮৪ বা ৬ শতাংশ যাত্রী অসন্তুষ্ট। বাকি ৩০৫ জনের কোনো মতামত নেই বা খুব বেশি। এই তিন অঙ্কের যোগফল ১ হাজার ৩৮৩ জন! কিন্তু ফলাফল অনুযায়ী জরিপে ১ হাজার ৩৬৬ জনের মতামত নেওয়া হয়েছে। উত্তরদাতারা কীভাবে জরিপ অংশগ্রহণকারীদের চেয়ে বেশি – উত্তরহীন প্রশ্ন। রেল সচিব বলেন, ‘এটা হতে পারে না। যদি তাই হয়, জরিপ বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ৫০ জনকে জিজ্ঞাসা করলেন। ৬০ জন উত্তর দিয়েছেন। কোনো ভুল আছে কিনা দেখতে হবে।
গত রোববার কমলাপুর স্টেশনে ১০ যাত্রীকে রেলওয়ের ১৪টি প্রশ্ন করে ।তাদের ৮০ শতাংশ বলেছেন, রেলওয়ের কর্মীদের কাছ থেকে কাঙ্খিত সেবা পান না তারা। বনলতা এক্সপ্রেসের যাত্রী কবিরুল ইসলাম বলেন, ট্রেনে খাবার বিক্রি, টাকা নেওয়া, টিকিট ছাড়া যাত্রী তোলা ছাড়া রেলকর্মীদের আর কোনো কাজ নেই।
দুই অঞ্চলের সিসিএম অফিস গত ডিসেম্বরে রেল ভবনে সমীক্ষার প্রথম ফলাফল পাঠায়। বেশি অসঙ্গতির কারণে রিপোর্ট ফেরত পাঠানো হয়। গত মাসের শেষ সপ্তাহে সংশোধিত প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এটি বাস্তবতার সাথে মেলে না।