চাইলে কি টাকা ছাপানো যায়?
টাকার লেনদেন ও চাহিদা নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আয়ের ওপর। যত বেশি কারখানা, প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। অর্থের চাহিদাকে প্রভাবিত করে। বৈদেশিক আয়ও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। কিন্তু সব টাকা মুদ্রিত নগদ আকারে নয়। বরং মোট পরিমাণের সামান্য অংশই নগদে ছাপা হয়। অবশিষ্ট পরিমাণ অ্যাকাউন্ট স্থানান্তরের উপর ভিত্তি করে। পুরো পরিমাণ একবারে প্রয়োজন হয় না। সেজন্য সব টাকা ছাপানোর দরকার নেই। তবে কি কোনো কারণে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইচ্ছামতো টাকা ছাপতে পারবে? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর হলো, ইচ্ছামত টাকা ছাপানো যায় না। সব পক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও টাকা ছাপিয়ে বাজারে আনতে অন্তত ১০ মাস সময় লাগে।
প্রথমত, অর্থনীতির আকার এবং চাহিদার উপর ভিত্তি করে বাজারে অর্থ ছাড়া হয়। আরেকটি অংশ সবসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংক ভল্টে সংরক্ষণ করা হয়। বাজারে টাকার চাহিদা বাড়লে মজুদ কমে যায়। চাহিদা কমে গেলে ইনভেন্টরি বাড়ে। এখন বলি হঠাৎ করেই চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। অন্য সব হিসাব ছাড়াও সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি টাকা ছাপিয়ে বাজারে দিতে পারে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকজন বলেছেন, ইচ্ছে করে টাকা ছাপানো যায় না। ধরা যাক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামীকাল টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর প্রথমে কাগজ ও কালি কেনার দরপত্র আহ্বান করতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় কমপক্ষে চার মাস সময় লাগে। আর কাগজ কেনার অর্ডার দেওয়ার পর দেশে আসতে আরও পাঁচ মাস লেগে যায়। আবার প্রতিটি কাগজে টাকার মূল্যের আলোকে ভিন্ন ভিন্ন, যেখানে ভ্যালু ওয়াটারমার্ক করা আছে। ফলে প্রতিটি মূল্যের ভিত্তিতে কাগজ আনতে হয়।
টাকাও এক ধরনের কাগজ। কিন্তু নিশ্চিত বিনিময় হারের কারণে এটি মূল্যবান হয়ে ওঠে। বর্তমানে, মোট লেনদেনের একটি বড় অংশ অনলাইন ভিত্তিক। ক্যাশলেস সোসাইটি তৈরির জন্য বাংলাদেশ QR কোড ভিত্তিক আন্তঃ লেনদেন ব্যবস্থা চালু করেছে। পরীক্ষামূলকভাবে মতিঝিল এলাকার ফুটপাতে ১২০টি দোকানে এ ধরনের লেনদেন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ক্যাশলেস হলে নগদ লেনদেন আরও কমবে৷ এটি সম্পূর্ণ ক্যাশলেস হলে প্রিন্টেড ক্যাশের প্রয়োজন হবে না।
মুদ্রার প্রচলনের আগে সভ্যতার প্রাথমিক যুগে পণ্যের বিনিময়ে পণ্য কেনাবেচা হতো। তারপর স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। সেখান থেকে এসেছে কাগজের টাকা। এক সময় দেশের স্বর্ণ ও রূপার মজুদের বিপরীতে নোট জারি করা হতো। পরবর্তীতে এ দুটির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা ও সরকারি গ্যারান্টির বিপরীতে মুদ্রা ছাপা হয়। সরকারি গ্যারান্টির বিপরীতে বেশি টাকা ছাপানো স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ায়। যার কারণে অনেক হিসাব-নিকাশ করে এমন নোট ইস্যু করা হয়। অবশ্য বাজারে নোট ইস্যু করা এবং নোট ছাপানো এক জিনিস নয়।
একটি বিষয় পরিষ্কার, একটি দেশের সম্পূর্ণ সঞ্চয় ছাপা নোট আকারে নয়। দৈনন্দিন ব্যবসা বা ব্যক্তিগত চাহিদার ভিত্তিতে বর্তমানে দেশে ছাপানো নগদ টাকার পরিমাণ ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মানুষের হাতে ছিল ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্কের ভল্টে ছিল। বাকি ২৫ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিলসহ বিভিন্ন শাখা অফিসের ভল্টে এবং সোনালী ব্যাংকের চেস্ট ব্রাঞ্চের ভল্টে রয়েছে। মানুষের আমানত, বিশেষ করে বড় আমানত, একবারে নগদে তোলা হয় না। যে কারণে এই পরিমাণ মুদ্রিত টাকার চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট।
দেশে মোট ছাপানো নোট এ রকম হলেও গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে জমার পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ৩৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ৭০ হাজার কোটি টাকা নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে।
এর বাইরে বীমা, শেয়ারবাজার বা এনজিওতে সঞ্চয় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রির বিপরীতে গত এক বছরে বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এসেছে ১৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ তারল্যের পরিমাণ কমেছে। এখন বাজারে তারল্য বাড়াতে সরকারের ঋণ চাহিদার সিংহভাগ জোগান দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি ৫০,০০০ কোটি টাকার পাঁচটি পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচিও চালু করেছে। এসব নোট বাজারে ছাপা হবে না। বরং বেশিরভাগই হবে অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফার ভিত্তিক।