সরেজমিন হাসপাতালের চিত্র।হাড় কাঁপানো শীতে শিশুর সীমাহীন কষ্ট
কথায় আছে, মাঘের শীতে বাঘও কাঁপে। মাঘের মাঝামাঝি ‘বাঘের কাঁপুনি’ শীত অনুভব করছেন উত্তর জনপদের মানুষ। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে তিন দিন ধরে মাঝারি ঠাণ্ডা চলছে। ফলে ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বেড়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য ‘রাহুর দশা’ চলছে। তাদের ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া এবং শ্বাসকষ্টের প্রবণতা বেশি। বৃদ্ধরাও পড়েছেন বিপাকে।
জান্নাতুন পৃথিবীর আলো দেখেছেন মাত্র পাঁচ মাস। মা জুলেখা তাকে নিয়ে চিন্তিত। মাগের ঠাণ্ডায় ক্ষতবিক্ষত জান্নাতুনের খোঁপা শরীর। তিনি ডায়রিয়ায় ভুগছেন। কানেকানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে মাদুর পেতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত এক মেয়ের সঙ্গে শীতের ঘুমহীন রাত। ঠান্ডায় ঠিকমতো কথাও বলতে পারছেন না। কাঁপতে কাঁপতে সে বলতে চাইল, ‘বারান্দার মেঝেতে খুব ঠান্ডা। কাপড় নেই, কম্বল নেই। শিশুর পাতলা পায়খানা। ওয়ার্ডের ভেতরে জায়গা নেই। সারারাত বাচ্চাকে কামড়াচ্ছে মশা। দেখছন না! ‘
শুধু একজন জুলেখা নয়, এমন শত শত অভিভাবক তাদের সন্তানদের চিকিৎসা নিতে এসে হাসপাতালের ওয়ার্ডে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। তবু শিশুকে রক্ষা করতে শীতের সঙ্গে তাদের দূর্দান্ত লড়াই।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সময় শিশুদের পর্যাপ্ত গরম পোশাক পরতে হবে। ঠাণ্ডা ও বাসি খাবার দেওয়া উচিত নয়। ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্টসহ ঠান্ডাজনিত কোনো রোগ হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৪ নং শিশু ওয়ার্ড। এখানে অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা মাত্র ২৬টি। দেখা গেছে, রোববার দুপুর ১২টার দিকে সেখানে ১০৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। বিছানা ও মেঝেতে জায়গা নেই। বারান্দার মেঝেতে রোগীর দাঁড়ানোর জায়গা নেই। ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স হোসনে আরা বলেন, ‘এখানে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার রোগী বেশি। ওয়ার্ডে জায়গা নেই। তাই মেঝে ও বারান্দায় রোগী রয়েছে। শুধু ২৪ নম্বর ওয়ার্ড নয়, হাসপাতালের সব শিশু ওয়ার্ডেই এখন বাড়ছে রোগীর চাপ। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা বেশি।
রোগীরা জানান, হাসপাতালের কক্ষে জায়গা নেই। তাই রোগীকে থাকতে হয় বারান্দায়। কিন্তু রাতের বেলা বারান্দায় খুব ঠান্ডা। এই ঠান্ডায় শিশুদের কষ্ট হচ্ছে। এছাড়া মশার কামড়ে শিশু ও অভিভাবকরা অস্থির।
বাগমারা থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত এক শিশুকে নিয়ে ভর্তি রয়েছেন রাবিয়া। তিনি বলেন, ওয়ার্ডের ভেতরে কোনো জায়গা নেই। তাই আমাকে বারান্দায় থাকতে হচ্ছে। বারান্দায় মেলা ঠান্ডা। তাই আমরা বাচ্চা নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। ‘
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, “১২০০ শয্যার হাসপাতালে প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোগী রয়েছে। তাদের যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জায়গা নেই। সংকট নিরসনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। বর্তমানে বারান্দাগুলো থাইগ্লাস দিয়ে ঢেকে রোগীদের ঠাণ্ডা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। এটা শীঘ্রই হবে।’
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: ওয়ার্ডে রোগী ও অভিভাবকদের ভিড় কোলাহল। শয্যাসংকটের কারণে অনেক রোগীও মেঝেতে পড়ে আছে। এক শয্যায় তিন শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। ভিড় ঠেলে চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসক-নার্সরা। উত্তরাঞ্চলে শীতের কারণে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। তাই শয্যা খালি না থাকায় নতুন রোগীদের পুরনো রোগীদের মতো একই শয্যা দেওয়া হচ্ছে। ফলে চিকিৎসা সেবা পেতে ও দিতে রোগী, অভিভাবক, চিকিৎসক, নার্সসহ সবাইকে ‘লড়াই’ করতে হয়। এমন চিত্র রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৯ ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডের শিশু ওয়ার্ডের। নীলফামারীর সৈয়দপুরের বাসিন্দা গুদিয়া (৩৫) এক সপ্তাহ আগে নবজাতককে নিয়ে শিশু ওয়ার্ডে আসেন। খালি বেড না থাকায় বৃদ্ধ রোগী তার নবজাতককে নিয়ে চিকিৎসাধীন। তিনি বলেন, একই বিছানায় একসঙ্গে তিন শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে পুরো ওয়ার্ডে মানুষের হাহাকার। অতিরিক্ত লোকের কথা বললে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, ভালো না লাগলে এখান থেকে চলে যান। গরীব মানুষ হওয়ায় কোনো পথ না পাওয়ায় এখানেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
চিলড্রেন কনসালটেন্ট ডা. মোঃ ফখরুল আলম বলেন, ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় শিশু বিভাগের রোগীরা ধারণক্ষমতার প্রায় তিনগুণ বেশি চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমরা যতটা সম্ভব নিয়মিত চিকিৎসার কাজ করছি।