খুন হলেন অভিনেত্রী শিমু।লাশ গুম করে নিখোঁজের গল্প ফাঁদে স্বামী! প্লাস্টিকের সুতোর রহস্য উদ্ঘাটন
অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম শিমু (৪১) নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করতেন। নিখোঁজ থেকে তার লাশ উদ্ধার এবং হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেফতারের ঘটনাও নাটকীয়।
পুলিশ বলছে, শিমুর স্বামী খন্দকার শাখাওয়াত আলীম নোবেল এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। বাল্য বন্ধু এসএমওয়াই আবদুল্লাহ ফরহাদ লাশ উদ্ধারে সহযোগিতা করেন। কিন্তু লাশ উদ্ধারের একদিন আগে নিখোঁজের জিডি করেন এই নোবেল। তিনি অন্যান্য আত্মীয়দের সাথে তার স্ত্রীকে খুঁজছিলেন। তবে যে প্লাস্টিকের সুতা দিয়ে তিনি লাশের বস্তা সেলাই করেছিলেন, সেই সুতার বান্ডিলটি নোবেলের গাড়িতে পড়ে ছিল। লাশ ফেলে যাওয়ার পর পানি দিয়ে গাড়ি পরিষ্কার করে ব্লিচিং পাউডার ছিটানোর লক্ষণ তোয়াক্কা করেনি পুলিশ। নোবেল এবং তার বন্ধুরা সহজেই এই লক্ষণগুলিতে ধরা পড়েছিল।
সোমবার সকালে ঢাকার কেরানীগঞ্জের আলীপুর ব্রিজের পাশে একটি ঝোপ থেকে শিমুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তখন পরিচয় পাওয়া না গেলেও রাতে আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করে জানা যায় লাশটি অভিনেত্রী শিমুর। রাতে রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসা থেকে নোবেল ও ফরহাদকে গ্রেপ্তার করে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা পুলিশ।
নোবেল ও ফরহাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন নিহতের বড় ভাই। আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে। গতকাল নোবেল ও ফরহাদকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কর্মকর্তারা দাবি করেন, পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহের কারণে নোবেল তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন। তবে শিমুরার পরিবার এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করলেও হত্যাকারী কে তারা জানে না বলে জানিয়েছে। শিমু-নোবেল দম্পতির সংসারে এমন কোনো সমস্যা ছিল না যা খুন হতে পারে।
শিমুর বোন ফাতেমা নিশা বলেন, ‘নোবেলের সঙ্গে আমার বোনের কোনো ঝগড়া ছিল না। ১৮ বছরের তাদের সংসার। তাদের প্রেমের বিয়ে । আমার বোন আমার সাথে সবকিছু শেয়ার করে।
হত্যার কারণ : ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার মঙ্গলবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে শিমু হত্যার বিষয়টি জানান। এরপর তাকে ও তার বন্ধু ফরহাদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
পুলিশ সুপার বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নোবেল তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেছে। তাদের দাম্পত্য কলহ ও পারিবারিক কলহের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে জানা গেছে।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুস সালাম বলেন, পুলিশ এখনই নোবেলের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। তার ভাষ্য যাচাই করা হবে।
গ্রিন রোডে নিজের বাড়িতে শ্বাসরুদ্ধকরন: পুলিশ বলছে, নোবেল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, শনিবার রাতে শিমুর সঙ্গে তার ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে তা তীব্র আকার ধারণ করে। সকাল ৮টার দিকে তিনি শিমুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। পরে বন্ধুকে ডেকে বস্তায় ভরে লাশ গাড়িতে নিয়ে যায়।
তবে শিমুলের বড় ভাই শহিদুল ইসলাম খোকন জানান, নোবেল ও শিমু ছাড়াও তাদের গ্রিন রোডের বাড়িতে দুই সন্তান রয়েছে। তারা জানত বাড়ির ভিতরে খুন হয়েছে কিনা। এ নিয়ে তাদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। ওসি আবদুস সালাম বলেন, শিশুদের বিষয়ে জানতে চাইলে নোবেল বলেন, তারা তখন ঘুমিয়ে ছিল। তারা ওঠার আগেই লাশ বের করা হয়।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, ময়নাতদন্তে শিমুর গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাকে দড়ি বা অনুরূপ কিছু দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয় করতে দেহ থেকে ভিসেরা ও ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছে।
লাশ গুমের ঘটনায় সহায়তাকারী বন্ধু : শিমু হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ ফরহাদের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে না পারলেও পুলিশ বলছে, এই ফরহাদ নোবেলের বন্ধু। হত্যাকাণ্ডের পর তিনি নোবেলকে সব কাজে সহযোগিতা করেছেন। শিমু নিহত হওয়ার পরপরই ফরহাদকে ডাকেন নোবেল। এরপর দুজনে মিলে লাশ বস্তায় ভরে গাড়িতে তুলে । ফরহাদ গাড়ি চালিয়ে কেরানীগঞ্জের দিকে যায়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নোবেল জানান, শিমুর লাশ দুটি পাটের বস্তায় প্লাস্টিকের সুতো দিয়ে উল্লম্বভাবে সেলাই করা ছিল। এরপর তিনি দারোয়ানকে নাস্তা আনতে পাঠান এবং লাশটি গাড়ির পেছনের সিটে রেখে চলে যান।
ফরহাদ জানান, সকালে একটি গাড়িতে শিমুর মরদেহ নিয়ে তারা প্রথমে মিরপুরে যান। কিন্তু লাশ ফেলার উপযুক্ত পরিবেশ না পেয়ে তারা বাড়ি ফিরে যান। রোববার সন্ধ্যায় তারা আবার লাশ ফেলার জন্য মোহাম্মদপুর ও বচিলা ব্রিজ এলাকায় ঘোরাঘুরি শুরু করে। রাত সাড়ে নয়টার দিকে আলিপুর ব্রিজে গিয়ে বস্তা ফেলে দেন তিনি।
প্লাস্টিকের সুতার সাহায্যে রহস্য উদঘাটন : পুলিশ জানায়, শিমুর শরীরে থাকা দুটি বস্তাই প্লাস্টিকের সুতো দিয়ে সেলাই করা ছিল। সোমবার রাতে নিজের পরিচয় জানার পর পুলিশ গ্রিন রোডে শিমুরার বাড়িতে গিয়ে তার স্বামী নোবেলের গাড়ি তল্লাশি করতে গিয়ে একটি প্লাস্টিকের সুতার বান্ডিল পায়। তাহলে বুঝতে বাকি রইল না, শিমুর হত্যাকারী কে।