বৈষম্য অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ভুল পথে নিয়ে যায়
সাউথ এশিয়া ইকোনমিক পলিসি নেটওয়ার্ক কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা
দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের অন্যতম অসম অঞ্চল। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই বৈষম্য বিদ্যমান। কিন্তু সমতা শুধু ন্যায্যতার দাবিই নয়, অগ্রগতির জন্যও প্রয়োজনীয়। বৈষম্য প্রতিভা বিকাশের সুযোগ হ্রাস করে। মানব পুঁজি গঠন বাধাগ্রস্ত হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ভুল পথে নিয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে। এ কারণে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন দরকার।
সামাজিক অগ্রগতি বিষয়ক সাউথ এশিয়া ইকোনমিক পলিসি নেটওয়ার্ক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এ সম্মেলন শুরু হয়। বিশ্বব্যাংক ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিজিআইডি) যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করে। এটি এ ধরনের ১১তম সম্মেলন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কাঙ্খিত সামাজিক অগ্রগতি প্রয়োজন। সেজন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রতিটি সেক্টরে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
তিনি বলেন, সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি মানুষকে তাদের পূর্ণ সক্ষমতার বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্য ও দারিদ্র্য দূর করতে হবে। তিনি বলেন, বৈষম্য দূর করতে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবেই দেশের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হবে।
স্পিকার বলেন, সরকার কৃষকদের জন্য ১০ টাকা ব্যাংক হিসাব, মেয়েদের উপবৃত্তি, আশ্রয় প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামারসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গ্রহণ করেছে। আইসিটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ হয়ে ওঠা তরুণদের অনেকেই এখন ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন। সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির ফলে সামাজিক অগ্রগতি সূচকে বাংলাদেশ এগিয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং কার্যকর সংসদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি আরও বলেন, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হলে নারী ও পুরুষ উভয়কেই দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। তবেই টেকসই সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত হবে।
আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লাহি সেক বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য সুস্পষ্ট। বৈষম্য প্রতিভা বিকাশ এবং মানব পুঁজি গঠনে বাধা সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ভুল নির্দেশ করে। তিনি বলেন, আন্তঃপ্রজন্মগত গতিশীলতার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে। এই অঞ্চলে যেসব শিশুর পিতামাতার ন্যূনতম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল তাদের অনুপাত ৯ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা আরও কম, মাত্র ৮ শতাংশ। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, আয় ও ভোগের ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য কমাতে হবে। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা প্রসঙ্গে আবদুলায়ে সেক বলেন, বৈষম্য কমাতে বিশ্বব্যাংক ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। ভবিষ্যতেও এই সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
স্বাগত বক্তব্যে বিজিআইডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের ক্ষেত্রে উচ্চ মাত্রার বৈষম্য রয়েছে, যা ন্যায়বিচারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থী। এই অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।
তিনি বলেন, সামাজিক অগ্রগতিতে পিছিয়ে থাকা মানে সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য চিহ্নিত করতে সংশ্লিষ্ট নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। যা সমতার পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতেও সাহায্য করতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ হ্যান্স টিমার বলেছেন, সুযোগের বৈষম্য হ্রাস করা এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সম্পর্কিত সমস্যাগুলিও রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির একটি অংশ।
সম্মেলনের দুই দিনে মোট ১০টি কার্য অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় ২০টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে। বিশ্বব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের গবেষকরা এসব প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন। বুধবার এই সম্মেলন শেষ হচ্ছে।