বেঁচে থাকার আকুতি জানাতে গিয়ে হামলা ও মামলার শিকার
বেঁচে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করতে গিয়েছিলেন তারা। তবে শিকার হতে হলো হামলার। থানায় মামলাও হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে অসহায় মানুষদের এভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কিডনি রোগী ও তাদের স্বজনরা ডায়ালাইসিস ফি না বাড়ানো ও ভর্তুকি বহাল রাখার দাবিতে কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন। মঙ্গলবার পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে।
ওই দিনরাত। পাঁচলাইশ থানার উপ-পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে মোস্তাকিম নামে এক রোগীর স্বজনসহ ৫০ থেকে ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের ওপর পুলিশের অভিযানের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। এ সময় পাঁচলাইশ থানার ওসি নজির উদ্দিন মজুমদারের নেতৃত্বে পুলিশ তাদের ওপর হামলা চালায়। একপর্যায়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে রোগী ও তার আত্মীয়কে থাপ্পড় ও ঘুষি মারতে দেখা যায়। এ সময় ওসির বিরুদ্ধে নারী রোগীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। এপিক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভেতরে রোগীর আত্মীয়কে প্রায় ১ মিনিট মারধরের পর মূল ফটকের ওপারে নিয়ে যেতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের। নারী রোগীর আত্মীয়কে মারধর না করার জন্য পুলিশ সদস্যদের কাছে অনুরোধ করতে ব্যর্থ হন। পুলিশের হাতে দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচার ও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন সচেতন নাগরিকরা।
প্রাইভেট ডায়ালাইসিসের জন্য প্রতিবার রোগীদের দিতে হয় সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের প্রতি মাসে অন্তত আটবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। সে অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে রোগীকে প্রায় ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়। একজন দরিদ্র রোগীর পক্ষে এই খরচ বহন করা কঠিন। সরকারি হাসপাতালই তাদের একমাত্র ভরসা।
চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কিডনির জটিলতায় ভুগছেন এমন দুই কোটি মানুষের মধ্যে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে, তাদের মাসে ৮ বার ডায়ালাইসিস করতে হয়। কিন্তু ৯০ শতাংশ মানুষের পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। মোট ৩৯ শতাংশ রোগী কয়েক সেশনের পরে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেন।
সরকার ২০১৭ সালে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে চমেক হাসপাতালের নিচতলায় একটি ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু করে। ভারতীয় কোম্পানি স্যান্ডর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস বাংলাদেশ (প্রা.) লিমিটেডের মাধ্যমে চট্টগ্রামের কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস করা হচ্ছে। তবে নতুন বছরের প্রথম দিনে সেবা নিতে আসা রোগীদের জানানো হয়, এখন থেকে এককালীন ডায়ালাইসিস ফি ভর্তুকি বাবদ ৫১০ টাকার পরিবর্তে ৫৩৫ টাকা দিতে হবে। ভর্তুকি ছাড়া ২ হাজার ৭৮৫ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার ৯৩৫ টাকা দিতে হবে। এছাড়াও, যে রোগীরা প্রতি মাসে কমপক্ষে 8 থেকে ১২ বার ভর্তুকিযুক্ত ডায়ালাইসিস পরিষেবা পেয়েছিলেন, তারা চার থেকে ছয় ক্ষেত্রে এই সুবিধা পাবেন। বাকিটা করতে হবে ২ হাজার ৯৩৫ টাকা করে। ফলে হঠাৎ করে ডায়ালাইসিসের খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক’ দাবি করে কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ করছেন শত শত রোগী ও তাদের স্বজনরা। চমেক হাসপাতাল ছাড়া এ অঞ্চলের অন্য কোথাও সাশ্রয়ী মূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা পাওয়ার সুযোগ না থাকায় ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ চট্টগ্রাম নগরীর ১৫টি উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে কিডনি রোগীরা এখানে আসেন। . এ জন্য রোগীর চাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
গলায় ডাক্তারের ব্যরস্থাপত্র ঝুলিয়ে ভিক্ষা করে ডায়ালাইসিসের টাকা সংগ্রহ করেন পটিয়ার বাসিন্দা। নুরুল। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় দুই মেয়ে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় নুরুলকে। ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধি তার জন্য ‘কব্জিতে কালশিটে’। ন্যায্য মূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা পাওয়ার জন্য কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে নুরুল বলেন, ‘শারীরিক অসুস্থতার কারণে পা দুটো একটুও নড়ছে না। আমি এখনও ঘরে বসে থাকতে পারি না। বাড়িতে দুই মেয়ে ও স্ত্রী আছে। আমি বাইরে না গেলে চুলা জ্বলে না। নিজের ওষুধ কিনতে পারছি না। তাই কষ্ট করে প্রতিদিন ভিক্ষা করি। ডায়ালাইসিস ফি আরও বাড়লে আমি বাঁচতে পারব না।’ এক রোগীর স্ত্রী সিমলা বেগম বলেন, ‘স্বামী অসুস্থ থাকায় কিছুই করতে পারে না। আমি প্রতিদিন কিছু মানুষের বাড়িতে কাজ করি। সেই টাকা দিয়ে আমার স্বামীর ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাচ্ছি। এককালীন ডায়ালাইসিসের জন্য টাকা জোগাড় করা কঠিন। ফি আরও বাড়ানো হলে আমার মতো অনেক রোগী ডায়ালাইসিস করাতে পারবেন না। গরীব-অসহায়রা কোথায় যাবে?’ পঞ্চাশ বছর বয়সী সুমন চৌধুরীকে প্রতি মাসে অন্তত আটবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। বাবাকে বাঁচাতে ডায়ালাইসিস সেবার দাবিতে আন্দোলনকারী মেয়ে পম্পি চৌধুরী বলেন, ‘চিকিৎসা নিতে গিয়ে হামলার শিকার হতে হয়েছে। আপনাকে প্রায়ই বাজে কথা শুনতে হয়। স্যান্ডোর নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে যাওয়া রোগীদেরও নিয়মিত দুর্ব্যবহার করা হয়। হয়তো আমাদের মতো আর কোনো দেশ নেই।