দাদনের মিথ্যা মামলায় ছিন্নভিন্ন একটি পরিবার।গর্ভবতী মা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন

0

কিশোরগঞ্জের জেসমিন বেগম ও পায়েল মিয়া বাড়িতে বহুল কাঙ্খিত প্রথম সন্তানকে উপভোগ করতে পারেননি। শিশুটি জন্ম থেকেই ঠান্ডাসহ নানা রোগে ভুগলেও তাকে চিকিৎসকের কাছে দেখাতে পারেননি চাতল মিলের এই শ্রমিক দম্পতি। ‘দাদন’ দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে। পায়েল মিয়া এখন পর্যন্ত শিশুটির মুখ দেখেনি।

এমনকি ওই মিথ্যা মামলায় জেসমিনের বাবা আবদুল কাদির ও বড় মেয়ে আকলিমা বেগম ১৫ দিনের জন্য জেল থেকে বের হন। পুলিশের তদন্তে তারা নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে। একটি পরিবারকে এভাবে ধ্বংস করার জন্য দায়ী সরদার কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার রফিকুল ইসলাম রবিউল। তিনি জোহরা-সুরোজ চাতাল মিলের শ্রমিক নেতা। তিনি শ্রমিকদের টাকা আত্মসাৎ করার জন্য তাদের নামে মামলা করেন। অনেক নারী কর্মীও তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।

মঙ্গলবার কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে জেসমিনের সঙ্গে দেখা হয় এই প্রতিবেদকের। কনকনে শীতে গ্রামের মানুষ ব্যস্ত থাকলেও গ্রেফতার আতঙ্কে জেসমিন ঘুমহীন। কোলে থাকা শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে।

পেটের ক্ষুধা মেটাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের সোহাগপুর এলাকার জোহরা-সুরোজ চাতাল মিলের রবিউলের সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন জেসমিন। কিন্তু সেখানে তাদের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। তিন-চার দিন অন্তর দুই থেকে তিন কেজি করে চাল দিতেন রবিউল। ফলে ডিম, দুধ বা ভালো খাবার ছিল না। এমনকি স্বামীর অনুপস্থিতিতে জেসমিনকে বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি করতো রফিকুল। পরে হুমকি দিয়ে চাতল ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় জেসমিন। পায়েলও স্ত্রীকে খুঁজে না পেয়ে চলে যায়।

জেসমিন বলেন, ‘জামাই বাড়িতে না থাকলে রফিকুল ঘরে হাত দিত। আর এসব কথা কাউকে না বলার জন্য আমাকে হুমকি দিত। আমি তাদের আর সহ্য করতে পারি না। তাই আমি পালিয়ে যেতে বাধ্য হলাম।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে জেসমিন বলেন, ‘আমার কাছে তার কোনো টাকা নেই। উল্টো রফিকুল আমার বেতনও দেয়নি। টাকা চাইলে তিনি বলতেন বছর শেষে হিসাব দেবেন। এত কিছু করার পরও আমার বাবা ও বোনকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে। গ্রেফতার এড়াতে আমিও পলাতক। আমার সন্তানের চিকিৎসাও করাতে পারছি না। পেটের সেলাইও কাটতে পারিনি। আমি এর থেকে মুক্তি চাই এবং রফিকুলের বিচার চাই।

জেসমিন ও পায়েলের পথে যৌন হয়রানির শিকার আরেক নারী শ্রমিকও পালিয়ে যায়। এরপর রফিকুল বাদী হয়ে আটজনের বিরুদ্ধে আত্মসাতের মামলা করেন। বুধবার ওই চাতালে গেলে আরও অনেক নারী রফিকুলের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। শেষে রফিকুলও মালিকের টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। এখানকার নারী শ্রমিকরা রফিকুলকে চরিত্রহীন ও লম্পট আখ্যা দিয়ে তার কঠোর শাস্তির দাবি জানান।

চাতালে কর্মরত ৬০ বছর বয়সী রুমা বেগম বলেন, চাতালে কর্মরত নারী শ্রমিকদের সঙ্গে রফিকুল সবসময় দুর্ব্যবহার করত। এমনকি মাঝে মাঝে আমার ঘরে ঢুকে আমাকে স্পর্শ করত। সেও জেসমিনের ঘরে ঢুকে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করার চেষ্টা করে। আমরা প্রতিবাদ করলে সে আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করত।’

চাতলের ব্যবস্থাপক মামুন খান জানান, জেসমিনের বাবা আব্দুল কাদির ও বোন আকলিমা কখনোই এই চাতালের শ্রমিক ছিলেন না। তিনি বলেন, রফিকুল চরিত্রহীন ব্যক্তি। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন। এখানে আগের ম্যানেজারের টাকা নিয়ে রফিকুল পালিয়ে যায়।

তবে রফিকুলের দাবি, পালিয়ে যাওয়া আটজন বকেয়া পরিশোধ করেননি। জেসমিনের বাবা ও বড় বোন কয়েকদিন এখানে কাজ করে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। চাতালের মালিককে টাকা দিতে না পেরে নিজেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

শ্রমিকদের টাকা দেওয়ার কোনো প্রমাণ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকরা আমাদের কাজে যোগ দিলেই আমরা টাকা দেই। কোন লেখা নেই। কখন এবং কত টাকা দেওয়া হবে তা শুধু আমাদের অ্যাকাউন্টে লেখা থাকে। এতে শ্রমিকদের কোনো স্বাক্ষর বা টিপস নেই। যৌন হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব মিথ্যা।’

মামলার বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) উপ-ব্যবস্থাপক (আইন) অ্যাডভোকেট একেএম বুলবুল আহমেদ বলেন, ‘রফিকুলের মামলার কোনো শক্ত ভিত্তি নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *