অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ছেই
সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা অস্থির। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে যে, ভবিষ্যতে অনেক দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমে যাবে এবং মন্দার ঝুঁকি বাড়বে। বাংলাদেশের মতো দেশ যাদের জিডিপি কমবে না বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, সেসব দেশ কি বিপদে পড়ছে না? সম্প্রতি আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টিনা জর্জিয়েভা এ বিষয়ে একটি উত্তর দিয়েছেন। তাঁর মতে, যেখানে প্রবৃদ্ধি হবে, সেখানে মন্দাও অনেকের জন্য অনুভূত হতে পারে। এটি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং মানুষের প্রকৃত আয় হ্রাসের কারণে।
দেশের সাধারণ মানুষ এখন দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলছেন—রাজনীতি ও অর্থনীতি। যারা দেশ-বিদেশের খোঁজখবর রাখেন, তাদের অনেকেরই প্রশ্ন- দেশে কি মন্দা চলছে? সাধারণ মানুষের এই প্রশ্নের জবাবে সরাসরি কিছু বলছেন না বিশ্লেষকরা। তবে অর্থনীতি বা মানুষের জীবন-জীবিকা যেমন নিম্নমুখী হচ্ছে, বিপদের আশঙ্কা বাড়ছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানও এমন ধারণাকে সমর্থন করে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর গত সাড়ে তিন মাসে অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে আরও দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বিভিন্ন বাজেট প্রাক্কলন অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
তার মতে, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সব অনুমানই একতরফা ও নিম্নগামী। যথারীতি, যখন একটি মন্দা আসে, চাহিদা হ্রাস করা উচিত। যেহেতু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অন্যান্য কারণ সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটায়, মুদ্রাস্ফীতি কমছে না। বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব সব দেশেই আসছে। এটি লক্ষ করা উচিত যে একই রোগ প্রতিটি ব্যক্তিকে আলাদাভাবে প্রভাবিত করে। যার ইমিউন সিস্টেম ভালো সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক জায়গায় দুর্বল। আর্থিক খাতে সংস্কারের অভাব আছে, সুশাসনের অভাব রয়েছে। ১ টাকার জিনিস ১০টাকায় কিনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এখন এই জায়গাগুলিতে আরও মনোযোগ দেওয়া উচিত।
অর্থনীতির আলোচনায় রাজনৈতিক দৃশ্যপটও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন, সাম্প্রতিক কিছু পরিস্থিতি এমন বার্তা দিচ্ছে- দেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতার দিকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ঘটনাবলী যাতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে না দেয় তা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। কারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। হঠাৎ করে টাকা কমে যাওয়ায় সমস্যা বেড়েছে। অন্যান্য দেশ ধীরে ধীরে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। বাংলাদেশ তা না করে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। মুদ্রার ক্রমান্বয়ে অবমূল্যায়নের ফলে আকস্মিক সংকট সৃষ্টি হতো না।
তিনি আরও বলেন, বিদেশের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চলতি হিসাব ভালো নয়। গত অর্থবছরে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি ছিল। আইএমএফ অনুমান করেছে যে এই অর্থবছরেও ঘাটতি মোটামুটি একই রকম থাকতে পারে। টানা দুই-তিন বছর এ ধরনের ঘাটতি দেখা দিলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।
সমস্যা কোথায়: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্য বিরোধ ছাড়া সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। ২০১৯ এর শুরুতে, করোনা সংক্রমণের কারণে পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। দেশে লকডাউন, সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সংরক্ষণ নীতিসহ নানা কারণে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও সংকটে রয়েছে। রপ্তানি ও রেমিটেন্স কমেছে। করোনার দুই বছরে অনেকের আয় কমেছে, কেউ বেকার হয়েছে। সমাজের একটি বড় অংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়ের ক্ষমতা হারায়। ২০২১ সালে, করোনার প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার পর কিছুটা গতি ছিল। সে সময় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক পণ্যের বাজার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এক বছরের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। ভোগ্যপণ্যের বাজারেও একই অবস্থা। এদিকে গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতি আরও অনিশ্চিত। ফলে বিপর্যয়ের পর বিশ্ব অর্থনীতি এখন মন্দার দিন গুনছে।