জোয়ারে ভাসছে উপকূল
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে অস্বাভাবিক জোয়ারে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, হাতিয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে তিন ফুট উচ্চতার জোয়ারে অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। স্কুলসহ বিভিন্ন ভবনে পানি উঠেছে। পটুয়াখালীর দশমিনায় পানি ঢুকে পড়ায় অর্ধশতাধিক বিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ রয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে নোয়াখালী হাতিয়ার সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
এদিকে নিম্নচাপের প্রভাবে গত রোববার রাত থেকে রাজধানীতে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ মঙ্গলবার থেকে ঢাকায় বৃষ্টি কিছুটা কমলেও দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশে তা আরও দুই দিন অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের ১৫টি জেলায় বন্যার পূর্বাভাস অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
গতকাল সমুদ্রবন্দরগুলোতে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত বহাল রাখা হয়েছে।
জোয়ারের কারণে খুলনার নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র এলাকা স্বাভাবিকের থেকে প্রায় তিন ফুট বেশি জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে। শিবসা নদীতে প্লাবিত হয়েছে পাইকগাছা উপজেলা সদর। গতকাল বিকেলে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় নগরীর শিপইয়ার্ড সড়ক ও আশপাশের এলাকা। নগরীর টুটপাড়া, চানমারী ও শিপইয়ার্ড এলাকার বাড়ির আঙিনায় পানি উঠেছে।
সম্প্রতি উপকূলীয় এলাকায় ‘অস্বাভাবিক জোয়ার’ নতুন দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শুধু ঘূর্ণিঝড়ের সময়ই নয়, অমাবস্যা-পূর্ণিমা বা বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ-নিম্নচাপের সময়ও অস্বাভাবিক জোয়ার-ভাটার কারণে নিম্নাঞ্চলে পানি বেড়ে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম জানান, তিন থেকে চার বছরের ব্যবধানে জোয়ারের উচ্চতা দেড় ফুট বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদীগুলোতে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা পানির চাপ বেড়েছে। এ ছাড়া পলি জমার কারণে নদীর পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণে ১২ থেকে ১৪ আগস্ট নদীতে উচ্চ জোয়ার ছিল। ওই তিন দিনে জোয়ার স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট বেশি ছিল। এখন আবার নিম্নচাপের কারণে জোয়ারের উচ্চতা বেড়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, নাব্যতা কমে যাওয়ায় নদীগুলো পানি ধরে রাখতে পারছে না। উচ্চ জোয়ার এখন উপকূলীয় মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে নতুন বিপর্যয়। জোয়ারের পানি উঠলে তা লোকালয়ে ও ফসলি জমিতে প্রবেশ করে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।
কয়রা উপজেলার গাজীপাড়া গ্রামের কৃষক গণেশ মণ্ডল বলেন, ১০ বছর আগে বড় জোয়ারের সময় কপোতাক্ষ নদী থেকে পানি আসতে দেখেছি। এখন বেড়িবাঁধের ধারে জোয়ারের পানি চলে আসে। একই উপজেলার শাকবাড়িয়া গ্রামের কাওছার শেখ বলেন, তিন-চার বছর ধরে নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা দেখছি।
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির জানান, নিম্নচাপের কারণে প্রায় তিন ফুট পানি বেড়েছে। করমজল এলাকায় বন্যার জমি প্লাবিত হয়েছে।
সাতক্ষীরার আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের গদাইপুরে খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ভাটার কারণে ২০০ বিঘা মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া গাবুরা, নাপিতখালী, জেলেখালী, ৩ নম্বর পোল্ডারসহ বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, আরও দু-একদিন আবহাওয়া এমনই থাকবে।
নিম্নচাপের কারণে বাগেরহাটের নিম্নাঞ্চল বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন উপজেলার শতাধিক গ্রাম। সাগর উত্তাল থাকায় শতাধিক মাছ ধরার ট্রলার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে গেছে। বাগেরহাট পৌর শহরের রাহাত মোড়, সাধন মোড়, পূর্ব বাসবতী, কেবি বাজারের পেছনের দিক, ভূমি অফিসের সামনে পুরাতন বাজার, মালোপাড়া, বাগেরহাট মাছের বাজার, কাঁচা বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে। সদর উপজেলার মাঝিডাঙ্গা আশ্রয়ণ প্রকল্প, চারগ্রাম, বিষ্ণুপুর; কচুয়া উপজেলার ভান্ডারখোলা, নরেন্দ্রপুর, প্রতাপপুর, সাংদিয়া, আফরা; মোরেলগঞ্জের প্রধান বাজার, উপজেলা পরিষদ কার্যালয় চত্বর, তেলিগাতি, হোগলাপাশা, ফুলহাতাসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
নিম্নচাপের কারণে রোববার থেকে সাগর উত্তাল রয়েছে। পটুয়াখালীতেও স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট বেশি জোয়ারের পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অন্তত পাঁচ হাজার মাছ ধরার ট্রলার উপকূলে আশ্রয় নিয়েছে। কুয়াকাটার মহিপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ রাজ জানান, মাছ ধরার সব ট্রলার নিরাপদে তীরে ফিরে এসেছে।
দশমিনা উপজেলার অর্ধশতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় দুই থেকে তিন ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানি প্রবেশের কারণে ১৪টি স্কুল বন্ধ রয়েছে।
নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপসহ কয়েকটি ইউনিয়নের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।