কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকদের মত।ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে ‘যুদ্ধ’ চায় মিয়ানমারের জান্তা
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, ক্রমাগত উস্কানি দিয়ে বাংলাদেশকে যুদ্ধে টেনে নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাদের ক্ষয়িষ্ণু শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের কার্যালয়, নেপিডোতে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন যে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করার পর থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটির সামরিক জান্তা তীব্র চাপের মধ্যে রয়েছে। এরই মধ্যে চরম অর্থনৈতিক সংকটে সেনা সরকার অভ্যন্তরীণভাবে বেশ সমস্যায় পড়েছে। আর এ কারণে তারা তাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায়। বিভিন্ন সমীকরণে বাংলাদেশকে সবচেয়ে উপযুক্ত যুদ্ধক্ষেত্র বলে মনে করে দেশটির সামরিক সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের সময় মিয়ানমারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয়েছে অং সান সুচির সরকারকে। এর পরে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পরে, কঠোর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশে ডলারের দাম বেড়ে যায়। ফলে আবারও বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে, যখন তেল এবং অন্যান্য নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন দেশে পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়েছিল। এতে ক্ষুব্ধ দেশের সাধারণ মানুষ। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের শাসক জান্তা তাদের দৃষ্টি সরাতে বড় ধরনের অভ্যন্তরীণ সংঘাত বা অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধের পথ খুঁজছে। এরই মধ্যে দেশটিতে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, এতে শত শত সেনা নিহত হয়েছে।
জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সীমান্ত প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারের পাঁচটি দেশ রয়েছে। এগুলো হলো- চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, লাওস ও বাংলাদেশ। চীন জান্তা সরকারের অন্যতম বন্ধু; তাদের সঙ্গে কোনো বিবাদে জড়াবে না দেশ। মিয়ানমারের মতো লাওস এবং থাইল্যান্ড প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ফলে তাদের সঙ্গে কোনো বিরোধ চান না। পরাশক্তি ভারতের বিরুদ্ধেও দেশের অধিকাংশ জনগণের কোনো দৃঢ় মনোভাব নেই। ফলে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে মিয়ানমারের কোনো লাভ নেই। রয়ে গেছে শুধু বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের মধ্যে মুসলিমবিরোধী মনোভাব রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি। বাংলাদেশীরা নিজ দেশে বহিরাগত। ফলে জান্তা সরকার সেখানে বাংলাদেশ ও মুসলিমবিরোধী তাস খেলতে চায়। তারা এখন যুদ্ধে জড়াতে পারলে জান্তা সরকার সাধারণ মানুষকে বোঝাবে যে এই মুহূর্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় থাকা খুবই প্রয়োজন। আর এ কারণেই মিয়ানমার প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে উস্কে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে দেশটির বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জোরালো সমর্থন পেয়ে আসছে। এমনকি রোহিঙ্গা নির্মূলেও তারা ছিল সেনাবাহিনীর সহযোগী। কিন্তু এই মুহূর্তে সমর্থন একেবারে তলানিতে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের ক্ষোভও বেড়ে যায়। কারণ, জান্তা সরকার দেশের মানুষকে স্বাভাবিক জীবন দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কার্যত ব্যর্থ রাষ্ট্রের পথে মিয়ানমার।
করোনা মহামারী, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি মিয়ানমারকে বেশ ভালোভাবেই সংকটে ফেলেছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দারিদ্র্য ৪২ শতাংশের বেশি। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় মাদকের উৎপাদন বাড়িয়েছে মিয়ানমার সরকার। জাতিসংঘের মতে, জান্তা সরকার মাদক ব্যবসাকে অর্থনীতিকে সমর্থন করার পাশাপাশি সামরিক বাহিনীকে অর্থ প্রদানের জন্য ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, মিয়ানমার সরকারের তিনটি সুবিধা রয়েছে। একটি হল অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি থেকে যুদ্ধের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। মিয়ানমার এটাকে বোঝা মনে করে। সংঘাতের ক্ষেত্রে প্রত্যাবাসন অবরুদ্ধ করা হবে। তৃতীয় কথা হলো, যুদ্ধ হলে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে শুরু করে অন্যত্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যা অগ্রসর হয়েছে তার সবই অবরুদ্ধ হয়ে যাবে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশিদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশের সামনে জাতীয় নির্বাচন। আর এ কারণে এ সময়টা বেছে নিয়েছে জান্তা।
ঢাকায় কর্মরত একটি পশ্চিমা দেশের দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত মিয়ানমারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। মিয়ানমারের মিশন থেকে আমাদের আপডেট দেওয়া হচ্ছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বরাবরই অভিযোগ করে আসছে, বাংলাদেশ থেকে বিদ্রোহীরা মিয়ানমারে গিয়ে সহিংসতা করেছে এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
মিয়ানমারের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের অভিযোগ করে আসছেন। তবে বাংলাদেশ
এর অবস্থান স্পষ্ট- অন্য কোনো দেশকে বাংলাদেশের মাটি সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এই বার্তা তাদের একাধিকবার দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সীমান্তে বাংলাদেশের নজরদারি ও পাহারা জোরদার করা হয়েছে।
বাংলাদেশে মর্টার শেল ও গোলাবর্ষণের প্রতিবাদে গত ২০ দিনে তিনবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকেছে ঢাকা। তা সত্ত্বেও দেশটি আকাশসীমা লঙ্ঘন করে চলেছে। একাধিকবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না দেশটি। বাংলাদেশ প্রথমে এটিকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখলেও এখন সতর্ক দৃষ্টিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির চেয়ে কম নয়।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারও অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে।