সাদিয়ার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়।চট্টগ্রামে নালায় মৃত্যুর ফাঁদ

0

শেহেরিন মাহমুদ সাদিয়া তার নানার সাথে চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। ডাক্তার দেখানোর পর তিনি চশমাও কেনেন। এরপর তিনি গাড়িতে করে বাড়ি ফেরার জন্য নানার হাত ধরে চট্টগ্রামের হালিশহরের বাদামতল এলাকার দিকে হাঁটছিলেন। হঠাৎ সাদিয়া নানার হাত থেকে ছিটকে ড্রেনে পড়ে যায়। নানা এবং মামা সঙ্গে সঙ্গে ড্রেনে ঝাঁপ দিলেন। তারা খুঁজে পায়নি। স্থানীয়রা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। শুরুতে তারাও হদিস পায়নি। পরে সিটি কর্পোরেশনের খননকারী আনা হয়। তারা প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে এক টন আবর্জনা পরিষ্কার করে সাদিয়ার লাশ নিয়ে আসে।

ঘটনার পর থেকে নানা হাজী জামাল বিলাপ করছেন। নীরব বাবা মোহাম্মদ আলী পরিবারের বড় মেয়েকে হারিয়েছেন। বিড়বিড় করে কি যেন বলতে চাইছেন? কিন্তু এটা পরিষ্কার নয়। চাচা জাকির হোসেন ভাতিজিকে হারানোর পর ক্ষুব্ধ। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে নারীদের কণ্ঠের গর্জন। প্রতিবেশীরাও শোক প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ চুপচাপ চোখের পানি ফেলছেন।

সাদিয়া (২০) মোহাম্মদ আলী এবং শেলী আক্তারের প্রথম সন্তান। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। সাদিয়া চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। সোমবার রাতে শহরের আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় একটি ড্রেনে পড়ে তিনি মারা যান। নানা

হাজী জামাল বলেন, ‘আমি মোটেও মনকে বুঝাতে পারছি না। নাতি আমার হাত ধরেছিল। বৃষ্টিতে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে পা পিছলে গিয়ে ড্রেনে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমার ছেলে এবং আমি ড্রেনে নেমে পড়ি। অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু স্রোতের জন্য কিছুই করতে পারিনি।

ভাতিজিকে হারানোর পর চাচা জাকির হোসেন খুব রেগে যান। তিনি বলেন, দেশে কোনো ন্যায়বিচার নেই। উন্নয়নের স্বার্থে সবকিছু করা হচ্ছে। এর আগেও এখানে মানুষ পড়েছেন; কিন্তু কারও মাথাব্যথা নেই। যদি ড্রেনে নিরাপত্তা বেড়া থাকত, আমার ভাতিজি পড়ে যেত না।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আগ্রাবাদের মাজারের গেট অতিক্রম করে এবং বাদামতলের দিকে ১০ মিটার যাওয়ার পর একটি খোলা খাল রয়েছে। যে কেউ এই এক পা হাঁটলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এখানে কোনো নিরাপত্তা বেড়া নেই। কোন সতর্কতা নেই। ছাত্রের মৃত্যুর পর সিটি কর্পোরেশন গতকাল বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ড্রেন ঘিরে ফেলে। সিডিএ শেখ মুজিব রোডে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে। নির্মাণের জন্য ফুটপাত সংকীর্ণ করা হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল দেখতে মানুষ ভিড় করছে। এ সময় নুরুল ইসলাম নামে এক পথচারী বলেন, ‘এখন আর বেড়া দিয়ে কি হবে, যা হয়েছে তা হয়েই গেছে। মানুষ মারা গেলেও তাদের টনক নড়ে না।

আরেক পথচারী বলেন, শহরে হাঁটা এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

ঘটনাস্থলে যাওয়া চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার বলেন, ড্রেনটি ফুটপাতের কাছাকাছি। কিন্তু ড্রেনে কোন স্ল্যাব ছিল না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চলমান নির্মাণের কারণে রাস্তায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিতে সেখানে পানি জমে ড্রেনের আকার নিয়েছে। স্ল্যাব, ড্রেন বা গর্ত না থাকায় বোঝার উপায় নেই।

তিনি বলেন, ড্রেনটি আবর্জনায় ভরা। অনেক চেষ্টা করেও ডুবুরিরা সেখানে পৌঁছাতে পারেনি। এটি আবার দক্ষিণে কর্ণফুলী নদীর দিকে টার্ন। চার ঘণ্টার চেষ্টার পর লাশ উদ্ধার করা হয়।

উদ্ধার করার সময় ঘটনাস্থলে থাকা ডবলমুরিং থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অর্ণব বড়ুয়া বলেন, “ড্রেনটি আবর্জনায় ভরা ছিল, যার কারণে ছাত্রিটি ড্রেনে পড়ে গিয়ে আটকে যায়। যদি ড্রেনটি পরিষ্কার থাকত, তাহলে হয়তো তাকে জীবিত উদ্ধার করা যেত। ‘

সিটি কর্পোরেশনের মতে, চট্টগ্রাম শহরে প্রায় ৯৪৬ কি:মি খাল রয়েছে। এখানে ১৬১ কিলোমিটার খাল রয়েছে। মাটির দিকে ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ ড্রেনে কোন স্ল্যাব নেই। খালের পাড়ে কোনো নিরাপত্তা বেড়া নেই।

বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তারপর ড্রেন-রাস্তা একঘেয়ে হয়ে যায়। ফলস্বরূপ, খালে মৃত্যু একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *