চকবাজার ট্র্যাজেডি।’পোলার লাশ নেওয়া লাগব, বুকটা চিড়ে যাইতেছে

0

‘দারিদ্র্যের সংসার, অল্প বয়সে ঢাকায় চাকরি করার জন্য পাঠাইলাম। আমার মত হতভাগা আর কে আছে? পোলার লাশ নিতে হবে! আমার বুক ফেটে যাচ্ছে’- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল মর্গের সামনে। মোস্তফা মাঝির হৃদয়বিদারক কান্না ছুঁয়ে গেছে সবাইকে। ছেলে মো. মোতালেবের (১৬) মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি বরিশালের হিজলা উপজেলার শংকরপাশা থেকে ঢাকায় ছুটে যান। গতকাল দুপুরে লাশটি মর্গের সামনে অপেক্ষা করছিল।

পুরান ঢাকার চকবাজারে একটি রেস্টুরেন্টে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মোতালেবসহ ছয়জনের লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। অন্য পাঁচ আত্মীয়ের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এ সময় স্বজনরা প্রশ্ন করেন- পেটের দায়ে ঢাকা আসা কি অপরাধ? প্রিয়জনকে কেন মরতে হয়? এর দায় কে নেবে?

গত সোমবার রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের কমলবাগের দেবীদাস ঘাট এলাকায় চারতলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডে মোতালেবসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়। বাকিরা হলেন ওসমান সরদার (২৫), বিল্লাল সরদার (২৬), স্বপন সরকার (১৯), মো. রুবেল (২৮) ও মো: শরীফ (১৫)। তারা ভবনের নিচতলায় বরিশাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ছিলেন।

এ ঘটনায় রুবেলের ভাই মো. এ ঘটনায় আলী বাদী হয়ে মঙ্গলবার চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, অবহেলা ও অসতর্ক কর্মকাণ্ডের কারণে অগ্নিকাণ্ড ও ছয়জনের প্রাণহানি ঘটেছে। কেরানীগঞ্জ থেকে হোটেল মালিক ফখরুদ্দিনকে আটক করেছে পুলিশ। মালিক মো. রানাকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। চকবাজার থানার ওসি আব্দুল কাইয়ুম  বলেন, ফখরুদ্দিনকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। বিচারক একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

গতকাল দুপুরে ঢাকার জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম মর্গে গিয়ে দাফনের জন্য নিহত ছয়জনের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা দেন। আর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে নিহতদের পরিবারকে ২ লাখ টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

নিহত রুবেলের বড় ভাই রাসেল হিলাল বলেন, টাকা দিয়ে কী হবে? আমি আমার ভাইকে ফিরে পাবো না। আমার ছোট ভাইকে চলে যেতে হলো, এই যন্ত্রণা কে বোঝাবে? মাদারীপুরের কালকিনি থানার দক্ষিণ অকাল বরিশ গ্রামে তার স্ত্রী-সন্তানকে আমরা কীভাবে সান্ত্বনা দেব?

নিহত মোস্তফা মাঝি ও রাসেলের মতো স্বজনরা লাশ নিয়ে গ্রামে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল লাশ দেওয়া হয়নি। সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ লাশের ডিএনএ নমুনা ও দাবিদার স্বজনদের সংগ্রহ করেছে। ডিএনএ প্রোফাইল মিলের পর আদালতের নির্দেশে লাশ হস্তান্তর করা হবে। এ জন্য প্রিয়জনের পরিবর্তে স্বজনরা কান্নাজড়িত হয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হন।

এদিকে গতকাল সরেজমিনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলে গিয়ে উৎসুক মানুষের ভিড় দেখা যায়। পুলিশি নজরদারির সময় রেস্টুরেন্টের ভেতরে অর্ধপোড়া টিন ও আটার খামির পড়ে থাকতে দেখা যায়। চেয়ার-টেবিল পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। হোটেলের অভ্যন্তরটি ছাদের সাথে লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। কাঁথা-বালিশের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, রেস্টুরেন্টটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। কর্মচারীরা দিন ও রাত দুই শিফটে কাজ করত। নাইট শিফটের শ্রমিকরা দিনের বেলা দ্বিতীয় তলায় ঘুমাতেন। সোমবার সকালে শিফট শেষ করে রাত ৯টার দিকে ছয়জন ঘুমিয়ে পড়েন।

চারতলা ভবনের পাশের দুটি ভবনেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এর একটি ভবনের নিচতলায় পুরনো জুতার গুদাম। সেখানে থাকা সব জুতা পুড়ে গেছে। ছাইয়ের বস্তা বের করছিলেন শ্রমিকরা। ঘটনাস্থলে আসা অন্তত ২০ জন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুরান ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের পর কয়েকদিন ধরে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হয়। পরে সবকিছু শান্ত হয়। প্লাস্টিক ও রাসায়নিক গুদামসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলোকে এ এলাকা থেকে সরানো না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার জাফর হোসেন বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। পরবর্তী শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার জন্য লাশ হস্তান্তর করা হয়নি। ডিএনএ প্রোফাইল মিলের পর শিগগিরই মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *