জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল, মানুষ আরও চাপে পড়েছে
মুদ্রাস্ফীতি ও ডলার সংকটের কারণে সাধারণ মানুষ এরই মধ্যে জীবন-যাপন করতে হিমশিম খাচ্ছে। ঠিক তখনই এল বড় দুঃসংবাদ। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে ৯ মাস পর ফের ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়াল সরকার। এবার অকটেন ও পেট্রোলের দামও বেড়েছে। এক লাফে দাম বেড়েছে ৪৭ শতাংশের বেশি। এটি সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও চাপে ফেলবে যারা ইতিমধ্যেই দ্রব্যমূল্যের চাপে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার আইএমএফ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে ভর্তুকি কমাতে তেলের দাম বাড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জ্বালানি তেলের দাম এর আগে এক লাফে এত বাড়ানো হয়নি।
বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমতে শুরু করলেও দেশে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৩৪ টাকা থেকে ১১৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এবার অকটেন ও পেট্রোলের দামও বেড়েছে। অকটেনের দাম লিটার প্রতি ৪৬ টাকা বেড়ে ৮৯ থেকে ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বেড়ে ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা হয়েছে।
গত নভেম্বরের মতো এবারও সময় না দিয়ে বর্ধিত দাম কার্যকর করা হয়েছে। শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে নতুন দামে তেল বিক্রি শুরু হয়। দুই ঘণ্টা আগে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ অধিদপ্তর দাম বৃদ্ধির গেজেট জারি করে। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই হাজার হাজার ক্রেতা সারাদেশের পেট্রোল পাম্পে ভিড় জমান। বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তবে পাম্পগুলো রাত ১২টা পর্যন্ত তেল বিক্রি বন্ধ রাখে।
সব মিলিয়ে তেলের দাম ৪৭ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে সরকার। এর আগে ৪ নভেম্বর ডিজেলের দাম প্রতি লিটার ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছিল। এতে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর দাম বৃদ্ধি বাজারে ধাক্কা দেবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। পরিবহন খরচ বাড়বে, ফলে জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। সেচ খরচও বাড়বে। এতে মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে খাদ্যপণ্য তৈরি হবে। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে।
দেশে জ্বালানি তেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। এর ৭৩ শতাংশ মেটানো হয় ডিজেল দিয়ে। ‘গরিব মানুষের তেল’ নামে পরিচিত কৃষি ও পরিবহনে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম এবার বেড়েছে ৪২ শতাংশ। একই হারে কেরোসিনের দামও বাড়িয়েছে সরকার। অকটেন ও পেট্রোলের দাম বেড়েছে ৫১ শতাংশের বেশি।
ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে পরিবহন ও কৃষি খাতে চাপ পড়বে। পণ্য পরিবহন খরচ, গণপরিবহনের ভাড়া বাড়বে। সেচ খরচ বাড়লে কৃষকের খরচও বাড়বে। সব মিলিয়ে দ্রব্যমূল্যের বন্য ঘোড়া লাগামহীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আন্তর্জাতিক বাজারে অকটেন ও পেট্রোলের দাম বাড়ানো হবে কি না, দাম বৃদ্ধির ন্যায্যতা প্রমাণ করে তা স্পষ্ট নয়। কারণ অকটেনের চাহিদার প্রায় অর্ধেক এবং শতভাগ পেট্রোল দেশে উৎপাদিত হয়।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, জনবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের কথা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়। যতদিন সম্ভব ছিল, দাম বাড়েনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক অনিশ্চয়তার কারণে দাম সমন্বয় করতে হচ্ছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ছয় মাসে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের লোকসান হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা। মূল্য ২০১৬ সালে হ্রাস করা হয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দামটি সংশোধন করা হবে। গতকালও তিনি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, বিশ্বব্যাপী তেলের দাম কমলেও অনির্বাচিত সরকার বাড়িয়েছে। জীবনযাত্রায় এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। সব কিছুর দাম বাড়বে।
সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এই অন্যায্য মূল্যবৃদ্ধি তারা সমর্থন করবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের ওপর সরকার ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স নেয়। দাম কমালে বাড়ানোর দরকার নেই। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম থাকায় গত ৮ বছরে তেল বিক্রি করে ৪৮ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে সরকারি সংস্থা বিপিসি। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ইতিমধ্যেই ৯৪ ডলারে নেমে এসেছে।
মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জন্য অভিশাপ হবে বলে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এক লাফে এত দাম বাড়ানো অন্যায়। খাদ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। করোনার কারণে সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। এর প্রভাবে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে।