অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় পরামর্শ।সাশ্রয়ী না হলে বিপদ
দেশটির সামষ্টিক অর্থনীতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে বেশ কিছুদিন ধরে নানা চাপের মধ্যে রয়েছে। এমনকি আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং ব্যয় কমিয়েও চাপ সামলানো যাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা চলছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবনতি হচ্ছে। সরকারের ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সাম্প্রতিক বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতি, যা শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারও নানা উদ্যোগ নিয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের সাশ্রয় এবং আমদানিতে ছুটে যাওয়া সহ লাভজনক হওয়ার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পাশাপাশি আরও কিছু উদ্যোগ প্রয়োজন। তারা ঋণের সুদের হার বাড়ানো, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ কমানো এবং জ্বালানির দাম সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবহারসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। মাঝারি এবং দীর্ঘমেয়াদে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে কয়লা উত্তোলন, গ্যাস কূপ খনন এবং অনুসন্ধানের উপর ফোকাস করারও সুপারিশ করা হয়। তবে উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন তারা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৭.৩০ শতাংশে। খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। গতকাল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি একশ ডলারে উঠেছে। এলএনজির দাম বেড়েছে ৪০ ডলার প্রতি এমএমবিটিইউ।
গম, ভুট্টা, সয়াবিন, পাম তেলের মতো খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমলেও গত বছরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। তুলা, লোহা, রাসায়নিক এবং অন্যান্য শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রেও একই কথা। এই পরিস্থিতির প্রধান কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি, যা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ও সরবরাহ শিগগিরই স্বাভাবিক হবে বলে আশা করা যাচ্ছে না। এদিকে বন্যার কারণে দেশের ২০টি জেলায় ধান ও সবজির উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ওইসব জেলার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের প্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও, রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে চাহিদার তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি হয়েছে। ফলে লেনদেনের ভারসাম্যে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমেছে। টাকার মান কমে যাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়ছে। আবার রেমিটেন্স কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদাও কমছে। এদিকে সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। লোডশেডিং হচ্ছে। গ্যাসের চাপও কমেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং খরচও বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরবরাহ ঘাটতির কারণেই মূলত মূল্যস্ফীতি। সরবরাহ না বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমবে না। সরবরাহ বাড়াতে হলে উৎপাদন বাড়াতে হবে। এর জন্য এসএমই খাতকে উৎসাহিত করতে একটি নীতি প্রয়োজন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক কারণে যেসব ক্ষেত্রে বাড়তি ব্যয়ের চাপ থাকে, সেসব ক্ষেত্রে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে হবে। যাইহোক, সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত যাতে সাশ্রয়ী মূল্যের উদ্যোগ দ্বারা উত্পাদন ব্যাহত না হয়। সরকারের পরিবহন খাতে প্রচুর জ্বালানি অপচয় ও অপব্যবহার হয়। এটা কমাতে হবে। তিনি বলেন, শুধু আমদানি নিয়ন্ত্রণ করলেই হবে না, রপ্তানি আয়ও সঠিকভাবে আনতে হবে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (EDF) ঋণের সময়মত পরিশোধ নিশ্চিত করার জন্য যত্ন নেওয়া আবশ্যক। সব ধরনের কারসাজি বন্ধে বাজারকে কঠোর হতে হবে। ব্যাংকগুলোকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ কমাতে হবে। অনেক ব্যাংক তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে ব্যবসা করে। এতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। এক বা দুটি নীতি নিয়ে নয়। যেখানেই করতে হবে, একসঙ্গে করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। জ্বালানি এখন বড় সমস্যা। গ্যাসের দাম বেড়েছে সাতগুণ। স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে। এতে লোডশেডিং বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে দৈনন্দিন জীবনে। এখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হতে পারে। কারণ, দেরিতে লাভ হবে না। মানুষ যদি একটু বেশি দাম দিয়েও তেল পায়, তাহলে ভালো। কষ্ট হলেও বেঁচে থাকা যায়।