‘বিকট শব্দে ঘুম ভাঙার পর দেখলাম ২ পুত্রবধূ-নাতি-ছেলের লাশ’

0

মেঘলা সকালের আলো-আঁধারি। ক্ষণে ক্ষণে বজ্রপাত, আকাশে বজ্রপাত; সঙ্গে ঘুম। সিলেটের জৈন্তাপুরের চিকনাগুল ইউনিয়নের সাতজানি গ্রামের মো. জুবায়ের আহমেদ (৩৫), ইলেকট্রিশিয়ান, টিলারের পাদদেশে থাকেন। বৃষ্টির রাতে পুরো পরিবার গভীর ঘুমে। আচমকাই ঘরের উপর টিলার মাটি ধসে পড়ে।

জুবায়ের মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আর ঘুম থেকে ওঠেননি। এই অনন্ত যাত্রায় জুবায়েরের সঙ্গী হলেন তার স্ত্রী সুমি বেগম (২৬), একমাত্র ছেলে সাফিউল ইসলাম সাফি (৫) এবং বাগদত্তা শামীম আরা বেগম (৪৮)। টিলার ভূমিধসে একই পরিবারের চার সদস্যের মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের মাতম।

সোমবার সকালে ভূমিধসের পর মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে স্থানীয়দের উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করে। আব্দুল করিম (৬০), খায়রুন নেশা (৬৫), রফিক আহমেদ (৬০), ফাইজা বেগম (২০), লুৎফা বেগম (১৮), রফিউল ইসলাম (১০), মেহেরুন নেশা (৪০) ও হাম্মাদ (৩) আহত হয়েছেন। তাদের কয়েকজনকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

সিলেট ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মনিরুজ্জামান জানান, ভূমিধসের খবর পেয়ে দুটি ইউনিট উদ্ধার অভিযান শুরু করে। ভূমিধসে আহত জুবায়েরের বাবা আব্দুল করিম বলেন, “আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। ঘুমের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল। সকালে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি। দেখলাম পুরো বাড়ি ভেঙ্গে পড়েছে। আমি মাটিতে শুয়ে আছি। আমার এক ছেলে, দুই ছেলের বউ আর কনিষ্ঠ নাতি আর জেগে ওঠেনি।’

প্রতিবেশী সাবুল আহমেদ বলেন, মসজিদের মাইক থেকে খবর শুনে দৌড়ে আসি। দেখলাম পুরো পাহাড় ধসে পড়েছে বাড়ির ওপর। এ সময় আমরা তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করেছি। পরে পুলিশ ও দমকলকর্মীরা আরেকটি লাশ উদ্ধার করে। জুবায়েরের পরিবার ১০ বছর ধরে টাইলারের পাদদেশে বসবাস করছিল।

স্থানীয় চিকনাগুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, পাহাড়ের ওপরে বা তার ওপরে অনেক পরিবার বসবাস করে। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি হওয়ায় এগুলো সরানো বা উচ্ছেদ করা যাবে না। এখানকার বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র তাই তাদের আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে এখন টাইলারের দিক থেকে অন্যদের সরিয়ে দেওয়া হবে।

সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী চিকনাগুল ইউনিয়নের মাঝখানে। এই মহাসড়কের পূর্বে হাওরে এবং পশ্চিমে ইউনিয়নের ৬, ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ছোট-বড় অনেক পাহাড় রয়েছে। এসব পাহাড় থেকে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ওই ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মশাদ্দার আলী মাটি কাটার দায়িত্বে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে। প্রতিবারই তিনি নতুন উদ্যোগ নিয়ে পাহাড় কেটে ফেলতে সক্ষম হন।

হাইকোর্টের আদেশে কোনো ধরনের পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ। পরিবেশ আইনে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে। জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর, শিকার খাঁ, ৬নং শামপুর, চাঁদঘাট, বাগেরখাল, ঠাকুরের মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ও টিলা কাটা হচ্ছে। প্রশাসনও উদাসীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *