রাসায়নিক আগুন নেভাতে ভুল প্রক্রিয়া
রাসায়নিক আগুনের সূত্রপাত এবং পরবর্তীতে বিস্ফোরণ যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার সর্বশেষ উদাহরণ সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপো। এর আগেও কেমিক্যালের কারণে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ। হাসেম ফুডস লিমিটেড, নিমতলী, চুড়িহাট্টা- একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনার দৃশ্য। দাহ্য পদার্থের উচ্চ স্তরের কারণে, সেই দুর্ঘটনাগুলি চরম বিপর্যয় এবং প্রাণহানি ঘটায়। এমন বাস্তবতায় রাসায়নিকের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কতটা সক্ষম তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু তাই নয়, রাসায়নিকের প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক কর্মী, প্রশিক্ষণ এবং অগ্নিনির্বাপণের সরঞ্জাম রয়েছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, আগুন লাগার কারণ নির্ধারণ না করেই বারবার ভুল পথ নেওয়া হচ্ছে। আপনি যখন পানি দিয়ে রাসায়নিক আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন, তখন আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের ক্ষেত্রে আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য ফেনা ব্যবহার করতে হয়। আর হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের মতো বিপজ্জনক পদার্থে পূর্ণ কোনো পাত্রে আগুন লাগলে ক্রেন দিয়ে দ্রুত অপসারণ করতে হবে। বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে রাসায়নিকের আগুনের ঝুঁকি বিবেচনা করা হয়নি। হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের নয়জন কর্মীও মর্মান্তিকভাবে মারা যান। আহত হয়েছেন ১৪ জন। একসঙ্গে এত শ্রমিকের ক্ষতি নজিরবিহীন। এ ঘটনার পর তাদের পরিবার, স্বজন ও সহকর্মীরা শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
বুয়েটের প্রকৌশলী আল ইমরান হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে অগ্নি ব্যবস্থাপনার ওপর উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি বলেন, রাসায়নিক দিয়ে আগুন লেগেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেলে সেখানে পানি ব্যবহার করা যাবে না। অক্সিজেন সরবরাহ না থাকলে আগুন জ্বলবে না। ফোমের ব্যবহার অক্সিজেন চেইন লাইনে এক ধরনের বাধা স্তর তৈরি করে। এরপর ধীরে ধীরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু এখানে আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বারবার একই ভুল করে পানি দিয়ে কেমিক্যালের আগুন নেভাতে যায়।
ইমরান হোসেন আরও বলেন, পৃথিবীতে রাসায়নিক আগুন নেভানোর আরেকটি টার্ম আছে। এদের কেমিক্যাল ফায়ার ফাইটার বলা হয়। ফায়ার সার্ভিসে এই যোদ্ধাদের হাতে গোনা কয়েকজন। বিশ্বে এটিও দেখা যায় যে দমকলকর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে প্রথমে রাসায়নিক সনাক্তকরণ কিট ব্যবহার করে। দুর্ঘটনাস্থলের বাতাসে কী ধরনের রাসায়নিক রয়েছে, তা ধরা পড়ে। তারপর সেই অনুযায়ী অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যেতে পারে। দেশে এমন কিট ব্যবহারের নজির খুব কমই আছে।
প্রকৌশলী ফয়সাল আহমেদ মার্কিন মালিকানাধীন রাসায়নিক প্রস্তুতকারক ট্রনক্সে দুই দশক ধরে কাজ করেছেন। তিনি এখন বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কর্মরত। ফয়সাল বলেন, আগুন নেভাতে কোথায় পানি ব্যবহার করতে হবে এবং কোথায় ফোম ব্যবহার করতে হবে তা জানা জরুরি। চট্টগ্রামের ঘটনার জন্য অনেকেই দায়ী। ডিপো কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা মানসম্মত ছিল কিনা তা দেখার বিষয়। বিস্ফোরক-বোঝাই আগুনের সংস্পর্শে আসার পর প্রতিটি কন্টেইনার একটি বড় ‘ককটেল’-এ পরিণত হয়। অতঃপর তা বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডে কিছু কৌশলগত ভুল ছিল। দাহ্য পদার্থ ভর্তি কন্টেইনারের এত কাছে গিয়ে আগুন নিভে গেলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া দেশে কী ধরনের রাসায়নিক রয়েছে তা নির্ধারণের কোনো তথ্যভাণ্ডার দেশে নেই। রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন।
ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) অনুসারে, হাইড্রোজেন পারক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। বিশুদ্ধ অবস্থায় একটি বর্ণহীন তরল। এটি একটি অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ। হাইড্রোজেন পারক্সাইডের জলীয় দ্রবণ সবসময় নিরাপত্তার কারণে ব্যবহার করা হয়। এটি রকেট জ্বালানীতে চালক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। হাইড্রোজেন পারক্সাইড উত্তপ্ত হলে তাপ পচনে বিস্ফোরক হিসেবে কাজ করে। তাই এসব রাসায়নিক নিরাপদে কম তাপে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগুন দ্রুত নেভাতে হলে তা ঘর বা বন্ধ জায়গায় আবদ্ধ রাখা প্রয়োজন। সীতাকুণ্ডে সেটা সম্ভব হয়নি। সেখানে আগুন লাগার পর হাইড্রোজেন সায়ানাইডের মতো গ্যাস তৈরি হতে পারে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম এবং প্রস্তুতি সহ পরিবেশে আগুন নিভিয়ে দিলে তিন সেকেন্ডের মধ্যে কেউ মারা যেতে পারে।
বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, আগুন লাগার পর প্রথম দুটি কাজ করা হয়েছে। প্রথমত, আগুন নিভিয়ে দেওয়া; দ্বিতীয়ত, আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করুন। রাসায়নিক আগুন নিশ্চিত হলে শুকনো পাউডার এবং রাসায়নিক ফেনা ব্যবহার করা যেতে পারে। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানতেন না সেখানে রাসায়নিক আছে। অগ্নিনির্বাপণের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ছিল।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ডিপোর পাত্রে হাইড্রোজেন পারক্সাইড ছিল, যা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের জানানো হয়নি। এই ধরনের রাসায়নিকের আগুন কুয়াশা পদ্ধতিতে নিভাতে হয়। আমি এখন ফেনা দিয়ে আগুন নিভানোর চেষ্টা করছি।